| শুক্রবার, ২৫ মে ২০১৮ | প্রিন্ট
‘মহা-বিদ্রোহী রণকান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত। যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণকান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত।’ হ্যাঁ, আজ প্রেম- মানবতা-বিদ্রোহ ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এই মহান পুরুষের জন্ম।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে নজরুল শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে কবি নজরুলের যখন আবির্ভাব তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এ দেশের সাহিত্যে এক বিশাল মহীরুহের মতো অবস্থান করছিলেন। সে সময় খুব কম কবিই রবীন্দ্র প্রভাব এড়িয়ে কাব্যচর্চায় সাফল্য পেয়েছিলেন। কাজী নজরুল ছিলেন সেই মুষ্টিমেয় কবির একজন, যিনি রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে বাংলা কবিতায় এক নতুন যুগের সূচনা করেন।
তিনি একদিকে ছিলেন বিদ্রোহী, অন্যদিকে মানবতাবাদী। তার গান জাতিকে জাগরণের পথে প্রেরণা যুগিয়েছে। ইসলামী গানের পাশাপাশি তিনি শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন।
সাংবাদিক হিসেবেও নজরুলের ভূমিকা অনন্য। তার সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা রচনার জন্য কবি রাজদ্রোহের অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি।
সংগ্রাম কী, কাকে বলে তা যেন ছেলেবেলাতেই জেনেছেন কাজী নজরুল। ১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যুর পর মাত্র দশ বছর বয়সেই রোজগারে নামেন তিনি। মক্তবের শিক্ষক, মুয়াজ্জিন ও মাজারের খাদেম হিসেবে কাজ করার পর ছেলেবেলার সেই ‘দুখু মিয়া’ যোগ দেন লেটোর দলে। লেটোর দলের হয়ে গান বাধা ও নাটকে অভিনয় করে চলে কিছু দিন। পরে রেলের ইংরেজ গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের কর্মচারী হিসেবেও কাজ করেছেন নজরুল।
রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরাম স্কুলে বিভিন্ন সময়ে লেখাপড়া করেন তিনি। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে প্রায়ই তাকে লেখাপড়া বন্ধ করে কাজে যোগ দিতে হয়। সিয়ারসোল রাজ স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল। প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে সেনাবাহিনীতে থাকার সময়ই নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের সূচনা ঘটে।
১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। সেখানে পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে। যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আকদ সম্পন্ন হওয়ার পরে কাবিনে নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমীলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি মুসলিম হয়ে ও চার সন্তানের নাম হিন্দু এবং মুসলিম উভয় নামেই নামকরণ করেন। যেমন : কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।
নজরুল চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রায় ৩০০০ গান লেখেন। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, দোলন চাঁপা, ছায়ানট, ইত্যাদি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা তার উপন্যাস। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা ইত্যাদি তার বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ।
তিনি সুগায়ক ছিলেন। ‘ধ্রুব’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেন। কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন তার বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তাকে নিয়ে যান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। নজরুল যেমন রবীন্দ্রনাথকে তার বই উৎসর্গ করেছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করেন নজরুলকে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই বিস্ময়কর প্রতিভার কখনই ধনসম্পদের প্রতি আগ্রহ ছিল না। এজন্য দারিদ্র্যতা ছিল তার চিরসঙ্গী। তিনি জগতের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্ট গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে হঠাৎ করেই তার সাহিত্য সাধনা স্তব্ধ হয়ে যায়।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা-গান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্যতম প্রেরণা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে সসম্মানে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মান দেন।
১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ জন্মদিনে তারই ভাষায় বলতে হয়, ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির।’
Posted ১১:৫৬ | শুক্রবার, ২৫ মে ২০১৮
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Athar Hossain