
| রবিবার, ০৯ এপ্রিল ২০১৭ | প্রিন্ট
আমরা সবাই জীবনে এক বার হলেও একটি প্রচলিত বিতর্কে জরিয়েছি। শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে কে এগিয়ে? রোনাল্ডো না মেসি? আজ আমরা এই প্রশ্নটির যথাযথ উত্তর খোজার চেষ্টা করব। আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি ছোটবেলাতেই নিজ প্রতিভাবলে স্পেনের জায়ান্ট ক্লাব বার্সালোনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাইতো ‘গ্রোথ হরমন ডেফিসিয়েন্সিতে’ ভোগা ১৩ বছরের ছেলেটির সকল চিকিৎসার ভার বহন করার শর্তে তাকে নিজের করে নেয় বার্সালোনা।
অন্যদিকে ২০০৩ সালে ইংলিশ জায়ান্ট ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পর্তুগালে গিয়েছিল পর্তুগালের ক্লাব স্পোর্টিং লিসবন এর সাথে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে এবং সেই ম্যাচ তারা হেরে যায় ৩-১ ব্যবধানে। তখনি ইউনাইটেড এর খেলোয়াড়েরা ইউনাইটেড কোচ ফার্গুসনের কাছে আবদার করে সারা ম্যাচে অসাধারণ খেলা ১৮ বছর বয়সী ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোকে নিজেদের দলে নিতে। ফার্গুসনও রত্ন চিনতে ভুল করেননি। এইতো ছিল ফুটবল বিশ্বের বড় আসরে দুই মহাতারকার আগমনের গল্প এবং এর পরে শুরু হয় গোটা পৃথিবী কাঁপানো এক শ্রেষ্ঠত্বের দ্বৈরথ।
মেসি বনাম রোনালদো:
ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো | লিওনেল মেসি | |
পুরো নাম | ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো ডস সান্তস এভেইরো | লিওনেল আন্দ্রেস মেসি |
উচ্চতা | ৬ ফুট ১ ইঞ্ছি | ৫ ফুট ৭ ইঞ্ছি |
জন্ম তারিখ | ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ [বয়স ৩২] | ২৪ জুন ১৯৮৭ [ বয়স ২৯] |
জন্মস্থান | ফুনচাল, মাদেইরা, পর্তুগাল | রোসারিও, সান্তা ফে, আর্জেন্টিনা |
পজিশন | ফরোয়ার্ড | ফরোয়ার্ড |
নম্বর | ৭ | ১০ |
বর্তমান ক্লাব | রিয়াল মাদ্রিদ | বার্সালোনা |
এপিয়ারেন্স
(ক্লাব এবং দেশ) |
৮৪২ | ৬৮৮ |
গোল সংখ্যা
(ক্লাব এবং দেশ) |
৫৮৩ | ৫৫২ |
জাতীয় দল | পর্তুগাল | আর্জেন্টিনা |
শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে, প্রথমত আমরা ব্যক্তিগত পরিপ্রেক্ষিতে তুলনা করবো। ক্ষিপ্রতা,দক্ষতা, গতি ও নির্ভুল লক্ষ্যর এক অপূর্ব মিশেল রোনালদো। বছরের পর বছর স্বীয় গুনে বার বার প্রতিপক্ষের গোলে লক্ষ্যভেদ করে জন্ম দিয়েছেন বিস্ময়ের। রোনালদোর দুই পায়েই অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে ও ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে পরীক্ষিত।
মেসির সেটা এখনো করা বাকি। রোনালদোর খেলা মাপা, দৌড়ের গতিপথ থেকে শুরু করে ফিনিশিং শট পর্যন্ত সবকিছুতেই যৌক্তিকতার ছোঁয়া। এরকম নিয়মতান্ত্রিক খেলায় রোনালদোর ধারেকাছেও কেউ নেই। মেসির খেলার ধরন অনেকাংশেই আলাদা। তার খেলায় শুদ্ধতার ছোঁয়া। অসাধারণ কলাকুশলী ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে একের একের পর এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে সুনিপুণ ফিনিশিং এ শৈল্পিক গোল করাকে ডালভাত করে ছেড়েছেন। তিনি মাঠে যা করে তা দর্শকদেরকে সম্মোহিত করে রাখে আর তাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে যে, “ও কি সত্যিই এটা করেছে?” মেসির খেলা ব্যাখ্যাতিত এবং প্রতিনিয়ত আমাদের কল্পনাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে যাচ্ছে।
ফিনিশিং এর ক্ষেত্রে মেসি অনেকাংশেই তার বা পায়ের উপর নির্ভরশীল। পেপ গার্দিওলা কোচ থাকাকালীন মেসি সাধারণত আক্রমণভাগের ডানে খেলত, সময়ের সাথে সাথে সে আক্রমণের মাঝে খেলা শুরু করে। ওয়ান অন ওয়ানে মেসির তুলনা নেই এবং তার ফিনিশিং এ ভুল ধরা কঠিন। বাঁকানো আর চিপ শটে অসংখ্য গোল করেছেন তিনি। ২০১৪/১৫ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে সেমিফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখ এর গোলরক্ষক নয়ারকে যেভাবে চিপ শটে পরাস্ত করেন তা বিস্ময়ের যোগান দেয়। পরবর্তীতে ওই গোলটি সেই মৌসুমের জন্য ইউরোপ সেরা গোলের পুরস্কার জিতে নেয়। যদিও রোনালদো ডানহাতি কিন্তু দুই পায়েই তার সমান নিয়ন্ত্রণ। তার দুর্বল বাম পায়ে তিনি করেছেন ১০৩ টি গোল যা তার মোট গোলের ১৭.৭৩% যা মেসির দুর্বল ডান পায়ে করা ৭৪ বা মোট গোলের ১৩.৪১% থেকে বেশি। রোনালদোর অন্যতম একটি ক্ষমতা হলো তার গোলার মত শট যা দিয়ে তিনি অসংখ্যবার লক্ষ্যভেদ করেছেন।
উচ্চতার কারণে মেসির থেকে হেডিং এ কিছুটা এগিয়ে রোনালদো। মেসির বেশিরভাগ গোলই আসে বা পা দিয়ে। অন্যদিকে রোনালদো তার শারীরিক গঠন ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে হেডিং এ বেশ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। ভয়ডর, ব্যথা সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজের সর্বস্ব দিয়ে হেড করতে রোনালদোর মধ্যে কোন জড়তা কাজ করে না। ফ্রি কিকেও রোনালদো এগিয়ে। তার গোলার মত শটের উত্তর সাধারণত গোলকিপারদের জানা থাকে না। তার ঘুরানো বাঁকানো শটেরও জুড়ি মেলা ভার। পরিস্থিতি বুঝে ওয়ালের উপরে বা নিচে দিয়ে ফ্রি কিক নেয়ায় তিনি অনন্য। মেসির ফ্রি কিকে পাশবিক গতি বা বল কিছুই নেই তবে তার ফিনেস শট অনেকবার ওয়াল ও গোলকিপারদের পরাস্ত করে জাল খুঁজে পেয়েছে। ফ্রি কিক থেকে মোট ৫১টি গোল আদায় করে নিয়েছেন রোনালদো আর মেসির ফ্রি কিক গোলসংখ্যা ৩৩টি।
ড্রিবলিং ও বল নিয়ন্ত্রণে মেসি এক জাদুকর যে বল দিয়ে প্রতিনিয়ত ভোজবাজির খেলা দেখিয়ে যাচ্ছেন। চারদিক ডিফেন্ডার দিয়ে ঘেরা থাকলেও কিভাবে যে কোন জাদুবলে তিনি ফাঁক ফোকর খুঁজে নেন তার কোন ব্যাখ্যা নেই। কাটাতে গিয়ে ডিফেন্ডারের আঘাতে পরে গিয়েও পরেন না মেসি। পরে যদি যানও এবং যখন মনে হয়যে আর কিছুই করার নেই তখনি তার পাস খুঁজে নেয় সতীর্থকে বা নিজেই কাকতালীয় ভাবে উঠে আবার ছুট দেন বল নিয়ে। প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভার এর থেকে ভাল ব্যবহার আর হয়তো হয়না। রোনালদোও ড্রিবলিং ও বল নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ এবং স্টেপ ওভারের বাদশাহ কিন্তু ড্রিবলিং তার প্রধান অস্ত্র নয়। ডিফেন্ডারদেরকে ছিটকে দেয়া বল ও গতিতেই রোনালদোর আস্থা। স্কিল ও টেকনিকে মেসিকে এগিয়ে রাখতে হয়। বল যেন আঠার মত তার পায়ে লেগে থাকে। ডিফেন্ডারের মাথার উপর দিয়ে বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই মেসি অনবদ্য। প্রতিভার প্রশ্নে রোনালদোকে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই, তার স্টেপ ওভার ও ফ্লিক অতুলনীয় এবং ফর্মে থাকলে তাকে ঠেকায় এ সাধ্য কার! তবুও সাধারণত নির্ভুলভাবে স্কিল ও টেকনিকের ব্যবহার করলেও মাঝে মাঝে তার প্রচেষ্টা বিফলে যায় এবং মেসির তুলনায় তা অনেকাংশে বেশি।
মেসি শারীরিকভাবে খুব বৃহৎ নন এবং খুব বেশি শক্তসমর্থও নন। তারপরও তিনি মাঠে নিজেকে ভালভাবেই সামলায় ও ভারসাম্য ধরে রাখেন। তাকে চার্জ করে পরাস্ত করা সাধারণত সম্ভব না এবং তাকে মাটিতে ফেলার উপায় হলো ফাউল করা। রোনালদো এ ব্যাপারে যেন বুনো পশু। প্রতিদিন ১০০০ বার প্রেস-আপ করার দাবি জানায় তিনি। তার অসাধারণ শারীরিক গঠনে আছে বুনো শক্তি ও গতির মিশেল। তাকে চার্জ করে পরাস্ত করা চিন্তারও বাইরে। তার পথ আটকানোর একমাত্র উপায় ফাউল। তার ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই আর পুরোপুরি পেশাদারভাবে নিজের যত্ন নিয়ে থাকেন পর্তুগীজ যুবরাজ।
অর্জন হিসেবে যদিও বছর সেরা ফুটবলার পুরস্কার ‘ব্যালন ডি অর’ রোনালদো আগে জিতেন ২০০৮ সালে, কিন্তু মেসি এরপর টানা ৪ বার (২০০৯-২০১২) জিতে ‘ব্যালন ডি অর’কে একপ্রকার নিজের সম্পত্তিতে পরিণত করেন। সব মিলিয়ে মোট ৫ বার “ব্যালন ডি অর” জিতেন মেসি। রোনালদোও কম যাননা ২০১৩ ও ২০১৪ তে টানাসহ মোট ৪ বার “ব্যালন ডি অর” জিতে নেন তিনি। মেসি সর্বসাকুল্যে ১৫টি বিশ্বরেকর্ডের মালিক অন্যদিকে রোনালদোর বিশ্বরেকর্ড ১০টি। ইউরোপিয়ান রেকর্ডের ক্ষেত্রে রোনালদো ভালই এগিয়ে। মেসির ১৪ টি ইউরোপিয়ান রেকর্ডের বিপক্ষে রোনালদোর ইউরোপিয়ান রেকর্ড ৩৬ টি! দেশের হয়ে দুজনেই সমান ৬ টি রেকর্ড অধিকারী।
দলীয় সাফল্যর পরিপ্রেক্ষিতে মেসি রোনালদো দুজনই ক্লাবের হয়ে অনেক অনেক অর্জন করেছেন। তাদের দলীয় সাফল্যর কাহিনী লেখা শুরু করলে শেষ হবে না। কিন্তু দুজনেরই খুব বড় একটা অপবাদ ছিল যে তারা শুধু ক্লাবের হয়ে ভাল খেলেন দেশের হয়ে না। কিন্তু রোনালদো ২০১৬ সালে দেশের হয়ে প্রথম ইউরো জিতে সেই অপবাদ ঘুচিয়েছেন। মেসির সামনেও যথেষ্ট সুযোগ ছিল দেশের হয়ে কোন ট্রফি জেতার। কিন্তু সে সুযোগ তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। সাম্প্রতিক সময়ে দুই বার কোপা আমেরিকা ও একবার ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে যেতে সক্ষম হলেও শেষ হাসি হাসতে পারেননি। দেশের হয়ে ট্রফি জিতে দলীয় অর্জনে বর্তমানে মেসির থেকে বেশ এগিয়ে আছেন রোনালদো। আর্জেন্টিনার মত ভাল দল পেয়ে মেসি যা করতে পারেননি, পর্তুগালের মত মাঝারী মানের দল পেয়েও তাই করে দেখিয়েছেন রোনালদো।
বৈজ্ঞানিকভাবে যদি আমরা শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করি তবে রোনালদো ভক্তদের একটু আশাহত হতেই হয়। অক্সফোর্ডের গবেষকদের করা এক গবেষণাতে পাওয়া গেছে যে বা পায়ের ফুটবলারদের প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভা ডান পায়ের ফুটবলারদের থেকে বেশি। বা পায়ের ফুটবলাররা একটু বেশি অনির্দেশ্য ও সৃজনশীল। তারা সহজে সমস্যার সমাধান করতে পারে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের খেলায় নতুন কিছু নিয়ে আসতে পারে। সেটা তো মেসির খেলা দেখলেই বোঝা যায়। মেসির খেলাই বুঝিয়ে দেয় কি পরিমাণ প্রতিভা তার মধ্যে। শুদ্ধ, নিটোল খেলা এবং এ জন্য সে স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেনা। অন্যদিকে কঠোর পরিশ্রম যে কখনো বৃথা যায় না এবং তা তোমাকে আশ্চর্যজনক ফল উপহার দিতে পারে তার যথাযথ উদাহরণ হলো রোনালদো। সে হয়তোবা ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে পরিশ্রমী খেলোয়াড়। তিনি তার অনন্য প্রতিভা ও মেধার সাথে কঠোর পরিশ্রমের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তীর কাতারে।
মেসি ও রোনালদো দুইজনেই এই প্রজন্মের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত এবং সর্বকালের সেরাদের বিতর্কেও তাদের অবাধ বিচরণ। নিজেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদেরকে আরও ভাল করার প্রত্যয়ের যোগানদাতা। হয়তো মানুষ যতদিন বেচে থাকবে ততদিন চলবে এই শ্রেষ্ঠত্বের বিতর্ক এবং আদৌ মানবজাতি এই বিতর্কের কোন নিষ্পত্তিমূলক ইতি টানতে পারবে কিনা সে নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে সমকালীন এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে মেসি ও রোনালদো দুইজনেরই খেলার উন্নতি সাধন করে নিজেদেরকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অন্যতম নিয়ামক তিনি ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
Posted ০৯:১১ | রবিবার, ০৯ এপ্রিল ২০১৭
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Athar Hossain