বৃহস্পতিবার রাত বারোটার আগেই রাত ১০টা এ্ক মিনিটে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সাধারণত রাত বারোটা এক মিনিটে ফাঁসি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে যেহেতু রাত বারোটা এক মিনিটে শুক্রবার শুরু হয়। সেহেতু শুক্রবার শুরুর আগেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ফাঁসি কার্যকর করতে চূড়ান্ত নির্দেশ না দিলেও কারা কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের নোটিশে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে এ কৌশল নেওয়া হয়েছে।
এদিকে রাত ৮টা ৫৬ মিনিটে ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার সিনিয়র জেল সুপার ফরমান এবং জেলার মাহবুব হাসান কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এরই মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রট, সিভিল সার্জেন ও ইমাম কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করেন।
ফাঁসির কার্যকরে জল্লাদের ভূমিকা পালন করেন, ৬০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি শাহজাহান ভূইয়া। তার সঙ্গে ছিলেন, আরও ৪ জল্লাদ শেখ কামরুজ্জামান, ফারুক, কালু ও বাবুল মিয়া।
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলার পাঁচ আসামিকে ফাঁসি কার্যকরের দায়িত্ব পালন করে জল্লাদ শাহজাহান ভূইয়া।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই অন্য একটি মামলায় কাদের মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ১৪ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তদন্ত শুরু হয় ওই বছরের ২১ জুলাই। গত বছরের ২৮ মে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ৩ জুলাই থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-২।
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ক্ষুব্ধ মানুষ সেদিন বিকেল থেকে জড়ো হতে থাকে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে। প্রতিবাদী এই মানুষগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে তোলে গণজাগরণ মঞ্চ।
এরপর সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) আইন সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) সংশোধন বিল, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। সংশোধনের ফলে আসামিপক্ষের মতো রাষ্ট্রপক্ষও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সমান সুযোগ পায়। আগে আইনে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল না।
আইন সংশোধনের পর গত ৩ মার্চ কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পরদিন ৪ মার্চ আপিল করেন কাদের মোল্লা। ১ এপ্রিল থেকে আপিলের শুনানি শুরু হয়।
শুনানি শেষ হওয়ার ৫৫ দিনের মাথায় ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। এরপর রায়ের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্ট থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়।
গত ৮ ডিসেম্বর বিকেলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়।
১০ ডিসেম্বর বিকেলে হঠাৎ করেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর স্ত্রী সানোয়ার জাহানের কাছে চিঠি দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সে অনুযায়ী রাত আটটার দিকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দুটো মাইক্রোবাসে করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে ফিরে যান। রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্টে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানান, ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হবে। ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতিও ছিল কারা কর্তৃপক্ষের। তবে ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিতের আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বাসায় হাজির হন কাদের মোল্লার আইনজীবীরা। তবে ঘোষিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগে তাঁর ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতি।
তিনি ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান।
শুনানি শেষে আজ বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন। ফলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আইনগত কোনো বাধা নেই বলে তখন জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যায় কাদের মোল্লার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করার অনুমতি দেয়।