রবিবার ২৩শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

আর্থিক খাত এখনো আ. লীগের সুবিধাভোগী আমলাদের নিয়ন্ত্রণে

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫ | প্রিন্ট

আর্থিক খাত এখনো আ. লীগের সুবিধাভোগী আমলাদের নিয়ন্ত্রণে

ডেস্ক রিপোর্ট : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার অনুগতরা এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের আর্থিক খাত। এস আলম, সালমান এফ রহমানসহ মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে আর্থিক খাতকে তুলে দিয়ে যারা দেশে ‘চোরতন্ত্র’ ও ‘লুটপাটতন্ত্র’ কায়েমে সহায়তা করেছিল, তারাই প্রশাসনসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বহাল রয়েছেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ও অনুগত ওইসব প্রভাবশালী আমলার ক্ষমতার প্রভাব মোটেও কমেনি।

বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে কখনোই পদবঞ্চিত ছিলেন না, বরং পুরস্কার হিসেবে প্রশাসনের শীর্ষ পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তারা এখনো বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত রয়েছেন। হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তস্রোতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ফ্যাসিস্ট হাসিনার অনুগতদের হাতেই রয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্বে আছেন মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। পতিত হাসিনার আমলে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে তাকে অর্থসচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অর্থাৎ হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া অর্থসচিব এখনো স্বপদেই বহাল রয়েছেন। ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সচিব হওয়ার আগে তিনি অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব পদে রয়েছেন নাজমা মোবারেক। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর তাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ৫ জুন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তিনি সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান এবং শিশু ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে তাকে পদায়ন করা হয়। সচিব হওয়ার আগে তিনি অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।

শেখ হাসিনার আরেক অনুগত ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত আবদুর রহমান খানকে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের ঠিক দেড় মাস আগে ২০২৪ সালের ১৬ মে তাকে পদোন্নতি দিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়। সচিব হওয়ার আগে তিনি একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। শেখ হাসিনার পতনের পর তাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব থেকে এনবিআরের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

মুসলিম চৌধুরী আওয়ামী সরকারের আমলে সুবিধাভোগীদের অন্যতম। শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন তিনি। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালীন সময়ে সরকারের কোন মন্ত্রণালয়ের সচিব কে হবেন সে বিষয়ে তিনি শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিতেন বলে জানা গেছে। ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর মুসলিম চৌধুরী সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে অর্থ সচিবের দায়িত্ব পান। সচিব হওয়ার আগে তিনি একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সাবেক এ আমলাকে অর্থ সচিব থেকে নয় মাসের মাথায় মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) হিসেবে নিয়োগ দেয়।

২০১৮ সালের জুন মাসে পাঁচ বছরের জন্য সাংবিধানিক ওই পদে নিয়োগ পান তিনি। ২০২২ সালে নির্বাচন কমিশন গঠনে ছয় সদস্যের যে সার্চ কমিটি গঠিত হয় তার একজন ছিলেন মুসলিম চৌধুরী। অবশ্য ইসি গঠনে আওয়ামী লীগ যে আইন তৈরি করেছিল, তখন আইনেই বলা রয়েছে, আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, সাংবিধানিক পদ সিএজি এবং পিএসসির চেয়ারম্যানের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি দুজন বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে ছয়জনের সার্চ কমিটি গঠন করবেন।

পদাধিকার বলে তিনি সার্চ কমিটির সদস্য ছিলেন। ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান মুসলিম চৌধুরী। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর ২৯ আগস্ট তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান।

চট্টগ্রামের রাউজানের বাসিন্দা হিসেবে তিনি বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন বলে অনেকেই মনে করছেন। প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূসের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে, যা রাউজানের পার্শ্ববর্তী। তার এ নিয়োগে চট্টগ্রামের একটা প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গেও তার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে বলে সূত্রের দাবি। মুসলিম চৌধুরী যখন অর্থসচিব ছিলেন তখন বিশ্বব্যাংকের একটি প্রজেক্ট ছিল, সে প্রজেক্টের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে আহসান এইচ মনসুরের পিআরআই। সে জন্য মুসলিম চৌধুরী এখনো সরকারের মধ্যে ব্যাপক প্রভাবশালী হিসেবে কাজ করছেন।

মুসলিম চৌধুরীর আপন ভাই মহসিন চৌধুরী পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদস্য। শেখ হাসিনার আমলে ২০২৪ সালের ৮ মে মহসিন চৌধুরী বিএসইসির কমিশনার পদে নিয়োগ পান। আগস্ট বিপ্লবের পর কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত পদত্যাগ করলে মহসিন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।

১৩ আগস্ট শেখ হাসিনার নিয়োগপ্রাপ্ত দুই কমিশনার অধ্যাপক ড. শামসুদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক ড. রুমানা ইসলাম পদত্যাগ করেন। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর তিন মাসের সময় দিয়ে কমিশনের অপর সদস্য ড. তারিকুজ্জামানের চুক্তি বাতিলের নোটিস দেওয়া হলে তিনি পদত্যাগ করেন। তার এ পদত্যাগের মাধ্যমে হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া কমিশনের সবাই বিদায় নিলেও অদৃশ্য কারণে রয়ে গেছেন মহসিন চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের আমলে অন্যতম সুবিধাভোগী আমলা। কমিশনে যোগ দেওয়ার আগে তিনি সচিব পদমর্যাদায় সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক ছিলেন।

এছাড়া ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মূলত সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে এবং আওয়ামী সরকারের প্রচণ্ড আস্থাশীল হিসেবে তিনি ওই পদে ছিলেন। ২০১৮ সালে ভোট ডাকাতির নির্বাচনে সহযোগিতার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর ১১ আগস্ট সব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের ঘোষণা দেয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে মহসিন চৌধুরী স্বপদেই শুধু বহাল থাকেননি, তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও করা হয়েছিল।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সচিব এম আসলাম আলমকে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আইডিআরএ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার সময় তখন তিনি সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। রিজার্ভ চুরির ঘটনা অনেক দিন পর্যন্ত গোপন ছিল, শুধু জানত বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তখন এ ঘটনা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসলাম আলমকে জানানো হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। এ ঘটনায় তাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়। পরে তাকে লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (পিএটিসি) রেক্টর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখান থেকে অবসরে যাওয়া এ কর্মকর্তাকে আইডিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার আরেক সুবিধাভোগী মোহাম্মদ জয়নুল বারীকে। তিনি ১২ সেপ্টেম্বর করপোরেশনের চেয়ারম্যান হন। ২০২২ সালে তিনি আইডিআরএ চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান। আইডিআরএ চেয়ারম্যান হওয়ার আগে তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। জয়নুল বারী আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলে জানা গেছে।

আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগী এসব আমলার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা আমলা। তারা পলিসি ফ্রেমে কাজ করেন না। অতীতে তারা কাজ করেছেন বলে তাদের আমরা দোষী বা নির্দোষ বলতে পারব না। তারা চাকরি করেছেন, এখন হয়তো বলা যেতে পারে তারা তো অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি। আয়নাঘরের কথা আমাদের মনে থাকার কথা। তখন ভয়ভীতির একটা পরিবেশ ছিল। প্রতিবাদ করার সাহস অনেকেরই ছিল না। অতীতের দিকে না তাকিয়ে এখন তারা কী করছে সেটা দেখা উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, অভিজ্ঞতার কথা বলে বিগত সময়ের সুবিধাভোগীদের এখনো প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যে আকাঙ্ক্ষা সে আকাঙ্ক্ষার সত্যিকার বাস্তবায়নে প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে।

সরকারের বাজেটের আকারের দিকে তাকালে আমরা অতীতের সে ধারাবাহিকতাই দেখতে পাচ্ছি। বড় আকারের বাজেট, সরকারের খরচ বাড়ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। শুধু অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে অতীতের প্রশাসনকে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক সময় বলা হতো শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এখন আমরা কী বিকল্প খুঁজে পাইনিÑ এ প্রশ্ন তুলে আল আমিন বলেন, আমাদের অবশ্যই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মানানসই প্রশাসন গড়ে তুলতে একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ০৭:৫০ | শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০
৩১  
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com