| বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩ | প্রিন্ট
এম আর ওয়াজেদ চৌধুরী (রায়হান)
পাঠক, প্রথমেই আপনাকে অনুরোধ করব দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর একবার নিরপেক্ষ চোখ বুলিয়ে নিতে। দেখুন তো এসব কিছুর মূল হোতা এই সাংবিধানিক স্বৈরাচার কিনা? আমাদের সবার বুঝতে আর বাকি নেই যে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এক সঙ্কটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে। চরম উদ্বিগ্নতায় কাটছে দেশের মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত। এ যেন স্বাধীন সার্বভৌম দেশে পরাধীনতার স্বাদ আস্বাদন। দেশের একজন সাধারণ দেশপ্রেমিক নাগরিক এবং আইনের ছাত্র হিসেবে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করি সমস্যাটা কোথায়? অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পর এই সমাধানটা পেলাম ‘সাংবিধানিক স্বৈরাচারের কবলে বাংলাদেশে’।
আমরা জানি যে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র বা শাসনতন্ত্র তথা পরিচালনা পদ্ধতি সংক্রান্ত নিয়মাবলির নামই হলো সংবিধান, যেটা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ঠিক বা প্রণয়ন করে থাকেন। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এর রয়েছে একটি সংবিধান। যেটা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রণীত হয় এবং একই সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এটি কার্যকর হয়। গত ৪২ বছরে নানা কারণে এই পবিত্র সংবিধানকে এই পর্যন্ত মোট ১৫ বার সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সমালোচিত তথা বিতর্কিত সংশোধনী হলো সংবিধানের সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনী। যেটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে জাতীয় সংসদে ২০১১ সালের ৩০ জুন পাস করে। এই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে প্রায় অর্ধশতাধিক বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ হলো : আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস বাদ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপসাধন, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন, দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য, ১৯৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতির (সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ) পুনর্বহাল, সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলী সংশোধন অযোগ্য, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন গঠন, সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে ৫০-এ উন্নীত, সংবিধানের তফসিল সংখ্যা ৪ থেকে ৭-এ উন্নীত, জরুরি অবস্থার মেয়াদ নির্দিষ্টকরণ, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি, জাতির পিতা, ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষণাপত্র যুক্তকরণ, বাংলাদেশের জনগণের জাতীয়তা বাঙালি এবং নাগরিকত্ব বাংলাদেশী প্রভৃতি। ইতিহাস বলে, যে দুইবার আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তখনই তারা সংবিধানে হাত দিয়েছে। বরাবরই সেটা করেছে নিজেদের মতো করে। কারও মতের তোয়াক্কা করা হয়নি এসব সংশোধনীর সময়।
পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে ৭-খ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাবনাসহ ৫৭টি অনুচ্ছেদের বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করে দেয়া হয়েছে। যার ফলে সংবিধানে নতুন কোনো পরিবর্তন কিংবা সংশোধনের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া সংবিধানের বিধানের বিপক্ষে বলা কিংবা আচরণ, বিদ্বেষ সৃষ্টি হতে পারে এমন কিছু শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে, যা মানবাধিকার তথা বাক-স্বাধীনতার সম্পূর্ণ বিপরীত। যেটি বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশে পরিলক্ষিত হয় না। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. তুহিন মালিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী বাংলাভিশনের এক টক শো’তে এসে একমত পোষণ করে বলেছিলেন যে, ‘বিশ্বে দুই ধরনের সংবিধান আছে, একটা হলো সুপরিবর্তনীয় সংবিধান, আরেকটি হলো দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো বিশ্বে একটিমাত্র দেশ হলো বাংলাদেশ যার সংবিধান অপরিবর্তনীয়! যেটা world-এর কোনো Constitutional & Political theory-তে উল্লেখ নেই! ড. দিলারা চৌধুরী আরও বলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলকে আবার নতুন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব লিখতে হবে এর জন্য।’
এই হচ্ছে বর্তমানে আমাদের পবিত্র সংবিধানের অবস্থা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো তার মধ্যে অন্যতম হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপসাধন, যেটা মূলত বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট ১৭৩ দিন হরতালসহ ২৬ দিন অসহযোগ এবং লাগাতার ৯৬ ঘণ্টার হরতাল দিয়েছিল, আন্দোলনে বহু লোক হতাহত হয়েছিল। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে আওয়ামী লীগ নিজেই একতরফাভাবে বহুল বিতর্কিত বিচারপতি খায়রুল হকের রায়কে ভিত্তি করে বাতিল করে দিল পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
এক আলোচনা সভায় সংবিধান প্রণেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, তড়িঘড়ি করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্ম দেয়া হয়েছে। সরকার তত্ত্বাবধায়ক সম্পর্কিত আদালতের রায়ের একটি অংশ মানলেও অন্য অংশটি মানেনি। এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যতবারই সুযোগ পেয়েছে, ততবারই সংবিধান সংশোধন করেছে তাদের বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য। জনগণের কল্যাণে তারা কখনোই সংবিধান পরিবর্তন করেনি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মীমাংসিত বিষয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে সরকার দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ প্রায় পঁচিশটি রাজনৈতিক দল এই পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরোধিতা, বিশেষ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আসছে বিলটি পাস হওয়ার পর থেকেই। প্রথমার্ধে অনশন, মানববন্ধন, জেলায় জেলায় মহাসমাবেশ, লংমার্চের মতো কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে আহ্বান করেছিল। কিন্তু সরকার একগুঁয়েমি ও অগণতান্ত্রিকভাবে কোনো কিছুই তোয়াক্কা না করে অটল থাকে। যার ফলে বিরোধী দল শেষের দিকে এসে কিছু কঠোর কর্মসূচি দেয়। সরকার তাতেও কোনো কর্ণপাত না করে মেয়াদ পূর্ণ করে। দেশ-বিদেশে নানা আলোচনা-সমালোচনাসহ টেলিভিশন টক শো থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকায় বহু লেখালেখি, প্রস্তাব ও পরামর্শ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করেননি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী নব্বই দিনে সংসদ অধিবেশন বসার বিধান রহিত করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদটি সংযোজিত করে সংসদের মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছে। ৭২(১) অনুচ্ছেদে যাতে নির্বাচনকালীন নব্বই দিন সময়ের মধ্যে সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠক পর্যন্ত ৬০ দিনের বিরতির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে রহিত করা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এ বিধানের জন্মদাতা স্বয়ং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিজেই সংবিধানের এই বিধানকে লঙ্ঘন করেছে।
তারপর মন্ত্রীদের পদত্যাগের নামে সাজালেন আরেক নাটক। এখানেও সংবিধানের লঙ্ঘন করা হয়েছে। সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের এক দফার ‘ক’ উপদফায় বলা আছে, ‘কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ সহজ কথায় কোনো মন্ত্রী যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন, তখনই তার পদ শূন্য হবে। সেটি গ্রহণ করা না করার কোনো বিষয় এতে উল্লেখ নেই। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংবিধানিকভাবে গত ১১ নভেম্বর থেকে সব মন্ত্রীর সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগ হয়ে গেছে। কিন্তু এই বিধির নির্মম পরিহাস, এখনও কিছু পদত্যাগকারী মন্ত্রী স্বপদে বহাল।
মন্ত্রীরা এখনও অবৈধ না কেন, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. তুহিন মালিক। সেটার কী অবস্থা আর জানতে পারিনি। তারপর গত ২০ নভেম্বর থেকে সম্পূর্ণ অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে দেশ শাসন করছে তথাকথিত সর্বদলীয় সরকার বা নির্বাচনকালীন নামক সরকার। সেই দিন নবম সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রপতি তাকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি প্রদান করেছে।
কিন্তু আমরা কেউ এখনও জানতে পারলাম না রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে কখন, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় অনুমতি দিলেন। রাষ্ট্রপতি কীভাবে প্রধানমন্ত্রীকে সরকার পরিচালনার অনুমতিদান করবেন সেটি স্পষ্ট বলা আছে সংবিধানের ৫৭(৩) ৫৮(৪) অনুচ্ছেদে। এই অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য করতে হলে আবশ্যকীয় শর্ত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হতে হবে। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়া ব্যতীত এই বিধানের সুবিধা নেয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন বলে যে সুবিধা দেয়া আছে তা পেতে হলে তার আগে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা তার পুরো সরকারের পদত্যাগপত্র স্বরূপ কোনো প্রমাণপত্র আজও আমরা দেখিনি। আবার অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সরকার পরিচালনার অনুমতিটি সংবিধানের ৫৫(৫) অনুচ্ছেদ মতে অবশ্যই ্তুসত্যায়িত বা প্রমাণীকৃত্থ হতে হবে। এ অনুমতিপত্র অবশ্যই ওই অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিধি দ্বারাও নির্ধারিত হতে হবে।
কিন্তু এখানেও কিছুই আমাদের চোখে পড়েনি। প্রকৃতপক্ষে এসব কিছুই তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়েই স্বৈরাচারী এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে ত্বরিত একটা সরকার গঠন করে ফেললেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের কোনো সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশেই ‘সর্বদলীয়’ বা ‘বহুদলীয়’ সরকার গঠনের কোনো নজির নেই। শুধু এই কপাল পোড়ার দেশে সব হয়। সে সরকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন ‘রুটিন কাজ’ পরিচালনার জন্য ৩০ সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা ও কয়েকজন উপদেষ্টা নিয়োগ দিলেন। গত সংসদ নির্বাচনের সময় ১১ জনের উপদেষ্টা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল এই ‘রুটিন কাজ’ করার জন্য। সেখানে কেন ৩০ জন মন্ত্রী-উপদেষ্টার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে? নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে সবার মাঝে।
সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মন্ত্রীদের নতুন করে শপথ নিতে হবে ও শপথে স্বাক্ষর দিতে হবে। পদত্যাগী মন্ত্রীদের নতুন করে শপথ না পড়িয়ে পুরনো ২০ পদত্যাগী সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নিয়োগটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধ। এছাড়াও সর্বদলীয় সরকারের রয়েছে ১০ জনের উপদেষ্টামণ্ডলী। অথচ সংবিধানের কোথাও ‘উপদেষ্টা’ সংক্রান্ত একটি শব্দও নেই, সেখানে একটি তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য এত উপদেষ্টা রাখার মানে কি?
সংবিধানের মূল ভিত্তি ১১ অনুচ্ছেদের শেষাংশে বলা হয়েছে—প্রশাসনের সব পর্যায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অথচ এই উপদেষ্টারা জনগণের প্রতিনিধি নয়। তাহলে এরা কার প্রতিনিধি? সুতরাং এই উপদেষ্টা নিয়োগ এবং এদের সব কার্যকলাপ সম্পূর্ণ অবৈধ ও অসাংবিধানিক। এ সরকার চাইলে যতদিন চাইবে ততদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে।
কারণ সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর ৫৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকবেন। ঠিক একই ধরনের ৫৬(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন মন্ত্রীরা দায়িত্ব না নিবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত পুরো মন্ত্রিসভা বহাল থাকবে। আবার ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন সংসদ সদস্যরা না আসেন ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান সংসদ বহাল থাকবে। এক কথায় ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার এ এক মহাসুযোগ।
অন্যদিকে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো লাগাতার অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে আসছে একের পর এক। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে মানুষ। ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশের এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুই দফায় ফোন করেছেন এবং চিঠি দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন এবং চিঠি দিয়েছেন।
অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে তিন দফায় ঢাকায় পাঠিয়ে সঙ্কট সুরাহার চেষ্টা করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি দুই দফায় টেলিফোন এবং চিঠি দিয়েছেন দুই শীর্ষ নেত্রীকে। সবাই সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য অনুরোধ করেন। সৈয়দা ওয়ার্সি এলেন অল্প দিনের ব্যবধানে দুইবার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে মার্কিন সিনেটে শুনানি হলো। কিন্তু তাদের এসব প্রস্তাব অনুরোধকে উপেক্ষা করে পাতানো নির্বাচনের পথে অগ্রসর হচ্ছে সর্বদলীয় সরকার তথা সর্বনাশা সরকার।
ব্রিটেনের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ইকোনমিস্ট বলেছে, বাংলাদেশে ধোঁকাবাজির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় জয়ী হলেও, এর ফলে হেরে যাবে বাংলাদেশ।
ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দুস্থান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ জ্বলছে। এর দায় ভারতেরও।
বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ‘কারাগার’ হিসেবে অভিহিত করেছে। কেউ কেউ বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বলেও রিপোর্ট করেছে।
বিরোধীদলীয় জোটকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে দিচ্ছে না, তাদের ওপর জেল-জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের রেকর্ডের পর রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে, নিজ দল ছাড়া অন্য কোনো দলের কর্মসূচি করতে দিচ্ছে না। মিছিল, সমাবেশ দেখলেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালাচ্ছে। অথচ এগুলো সব সাংবিধানিক অধিকার। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা পুরো অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।
সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের আজ ছিটেফোঁটাও দেখা মিলে না। প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকারের সব সুমহান বাণী। সার্বিক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিকে এক কথায় বলতে গেলে, ‘মানবাধিকার’ লঙ্ঘনের এক চরম স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ!
‘মানুষের জন্য সংবিধান, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়’ একথা সরকার ভুলে গিয়ে কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে।
জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন পবিত্র সংবিধান আজ এক ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিফলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবিধান পরিণত হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী হ্যান্ডবুকে। পবিত্র সংবিধানকে যথেচ্ছ কাটাছেঁড়ার পর এখন ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণও দেয়া হচ্ছে খেয়াল-খুশিমত। সে আলোকেই রাজনৈতিকভাবে সংবিধানের ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। এভাবে একের পর এক প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যভাবে পবিত্র সংবিধানকে লঙ্ঘন করেই চলেছে।
ড. তুহিন মালিকের ভাষায়, সাংবিধানিক স্বৈরাচার! এটি আমাদের দেশে নতুন। এর আগে সামরিক স্বৈরাচার, একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচার আমরা দেখেছি। ‘সর্বদলীয়’ সরকার শুধু ‘সর্বদোষীয়’ নয় বরং এটা সরাসরি অবৈধ এবং অসাংবিধানিক সরকার। সুতরাং আমি আবারও বলছি, ‘সাংবিধানিক স্বৈরাচারের কবলে বাংলাদেশে।’
লেখক : আইন বিভাগের ছাত্র, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
Posted ০১:৩১ | বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin