এত বিরাট (বিকট কিন্তু বলছি না) কারও নজর এড়াতে পারে না। ১৪ ডিসেম্বরের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্রধান শিরোনাম অনুযায়ী খবরটা এ রকম, ‘ফাঁকা মাঠে ১২৭’।ভাবছিলাম, ‘আমি নেতা হতে চাই’গোছের বিজ্ঞাপন পত্রিকায় ছাপাব নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে। পরে অবশ্য নেতা বনে গেলে ওই বিজ্ঞাপনের খরচের বহু গুণ টাকা নিঃসন্দেহে বিনা কষ্টে ‘তুলে’ নিতে পারতাম।বেশ কিছুদিন আগে অর্থাৎ শেখ হাসিনার সমুদ্রজয়ের জন্য যখন পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জোয়ার চলছিল, তখন একজনের নেতা হওয়ার বাসনা অধমকে চিন্তিত করেছিল। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রথম আলোয় বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছিলেন শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে। শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপানোকেই আমি বিশেষায়িত করছি, ‘আমি নেতা হতে চাই’ বলে। অধমের সমস্যা হলো নেতা হওয়ার গুণাবলির সমূহ অভাব। তাই বিজ্ঞাপনের বদলে এই ‘কলাম’ লিখে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দনবাণী পৌঁছে দেওয়ার একটা অতি নগণ্য প্রয়াস।
অভিনন্দন জানানোর মতো অনেকগুলো সাফল্য আছে এই ‘১২৭’ সংখ্যায়। শেখ হাসিনার পিতা, বঙ্গবন্ধুর আমলে একটাই সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, ১৯৭৩ সালে। কোন পত্রিকায় যেন দেখলাম, বঙ্গবন্ধুর আমলের ১৯৭৩-এর সেই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মাত্র ১১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর অভিনন্দন জানানোর মতো সাফল্য ১৯৮৮-এ এরশাদ সাহেবের। তাঁর অধীনে সেই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৮ জন প্রার্থী। সেই ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে অন্য দুই প্রধান দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ নেয়নি। প্রধান দুই দল নেই, তবু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত কুল্লে ১৮ জন।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অবশ্য খালেদা জিয়ার সাফল্যটা আরেকটু বেশি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ৪৯ জন। এবার শেখ হাসিনার সাফল্য অতীতের এসব সাফল্যকে নিঃসন্দেহে সম্পূর্ণ ম্লান করে দিয়েছে। অতীতে হাফ সেঞ্চুরিই হয়নি। এবার সেঞ্চুরি পার হয়ে ইতিমধ্যে ১৫১ আসন ছাড়িয়ে গেছে।
এরশাদ, জি এম কাদেরসহ জাতীয় পার্টির বেশ কিছু নেতার প্রত্যাহারপত্র নাকি ‘গ্রহণ’ করা হয়নি। পাক্কা খবর এখনো পাইনি, তাই আশা ছাড়িনি। তবে নতুন সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫১টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা শেখ হাসিনা এখনই প্রায় পেয়ে গেছেন। আর বাকি আসনগুলোর জন্য ৫ জানুয়ারি নির্বাচন-নির্বাচন খেলা। খেলা খেলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেকর্ডের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতারও একটা সর্বকালীন রেকর্ড গড়তে পারেন। তাহলে সত্যি সত্যিই অধম পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে ‘আমিও নেতা হতে চাই’ বলে ‘অভিনন্দন-বিজ্ঞাপন’ ছাপাব। এমন সর্বজয়ী নেত্রীর নেতৃত্ব বরণ করে নেওয়ার মতো সুযোগ জীবনে দুবার আসবে না।
যাহোক, আমাদের নির্বাচনের ইতিহাসে এ রকম অবিস্মরণীয় সাফল্যের জন্য পাঠক আপনাদের পছন্দমতো যতগুলো বিশেষণ ও উপাধি কল্পনা করতে পারেন, সবগুলো এখানে যুক্ত করুন—যেমন: বঙ্গবন্ধুকন্যা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। শেখ হাসিনাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে প্রাণঢালা হূদয় নিংড়ানো লাখো-কোটি অভিনন্দন।
কলম সঠিকভাবে চলছে না। একজন তৈলমর্দন-বিশারদের সাহায্য, নিদেনপক্ষে আওয়ামী লীগের বড় কোনো নেতার সাহায্য নিলে বহু বিশেষণ যোগ করে অভিনন্দনবার্তাটিকে আরও জোরালো করলে শ্রেয় হতো। বহু বহু তৈলমর্দন-‘বিশারদ’দের নাম জানি, যেহেতু টেলিভিশনের পর্দায় অহরহ দেখি। কিন্তু অধমের দুর্ভাগ্য—ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, তাই সাহায্য চাইতে পারছি না।
তবে প্রত্যাশা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের অতি ঘনিষ্ঠ তৈলমর্দন-বিশারদেরা এত বড় নির্বাচন বিজয়ের জন্য তাঁর জন্য একটা জুতসই উপাধি খুঁজে নিশ্চয় বের করবেন। যেমন ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নির্বাচন বিজয়ী’। যাঁরা নেতা হতে চান, তাঁরা নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিশেষণ-উপাধি দিয়ে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপাতে পারেন। আশা করি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাননীয় উপাচার্যরাও অভিনন্দন-বিজ্ঞাপনের মিছিলে অগ্রদূতের ভূমিকায় থাকবেন।
২.
১২৭ বা দেড় শতাধিক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার জন্যই শুধু যে শেখ হাসিনার অভিনন্দন প্রাপ্য তা নয়, ২০-২৫ বছর পর যখন ঘটনার অনেক দিন পর নির্মোহভাবে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস লেখা হবে, তখন স্বাধীনতার চার দশক পর এ দেশে জঙ্গি-মৌলবাদের উত্থানের পেছনে কার কত অবদান সেই বিশ্লেষণেও শেখ হাসিনার নাম কী অক্ষরে অর্থাৎ তামা, রুপা, সোনা না হীরা দিয়ে লেখা হবে, তা-ই বিশ্লেষণের বিষয়।
৫০ বছর পর তো পেছনে তাকিয়ে দেশের ইতিহাস লিখতে পারব না, তাই বর্তমানের ইতিহাস লিখতে গেলে লিখতে হবে যে আগামী অন্তত দুই যুগেও দেশের বেশ কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগ একটি আসনও জিততে পারবে না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে নিশ্চয়ই জিততে পারবে। কিন্তু সুষ্ঠু, অবাধ, অংশীদারি আর ভয়ভীতিহীন প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, (কক্সবাজারসহ বৃহত্তর অর্থে), লক্ষ্মীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, বৃহত্তর রাজশাহীর আরও বেশ কিছু অংশ, যেমন নাটোর ইত্যাদি ইত্যাদি স্থানে জিততে পারবে না।
৩.
প্রথম আলোর জনমত জরিপে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর শিক্ষামন্ত্রীর ব্যাপারে ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিল, যতদূর মনে পড়ে, ৯০ শতাংশের বেশি জরিপে অংশগ্রহণকারীর। কারণ অধমের দৃষ্টিতে দুটো— দক্ষতা আর ঘেউ ঘেউ না করা। নুরুল ইসলাম কর্মদক্ষ আর ঘেউ ঘেউ করেন না, একদম না, একবারও না।
অন্যের ব্যাপারে কটূক্তি করা, ব্যঙ্গ করা থেকে শুরু করে অশ্লীল ভাষায় চোর-ডাকাত-খুনি-জল্লাদ বলে গালমন্দ করার সঙ্গে দক্ষতা ও জনমনে গ্রহণযোগ্যতার একটা বিপরীত সম্পর্ক আছে। যার দক্ষতা ও সততা যত কম, তার সম্ভবত একটা সহজাত প্রবৃত্তি থাকে অশ্লীল-রূঢ় হওয়ার। যে অদক্ষ ও রূঢ়, জনগণ নিশ্চয় তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। চরম অদক্ষতা ও রূঢ়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বৈরতন্ত্রী চিন্তা ও কার্যক্রম। ফলে দেশে অনস্বীকার্যভাবে বিরাজ করছে গৃহযুদ্ধপূর্ব অবস্থা।
১৩ ডিসেম্বরের জুমার নামাজের পর মিনিট বিশেকের জন্য হলেও আমরা ঢাকায় বসে লক্ষ্মীপুর-সাতক্ষীরার অরাজকতা টের পেয়েছি। লক্ষ্মীপুর-সাতক্ষীরা ঢাকায় প্রায় চলে এসেছে। অকথ্য ও উসকানিমূলক ভাষায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলা আর প্রায় এক হাজার মানুষকে ক্রসফায়ার, আত্মরক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে খুন করা এবং হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষ খাওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ভরসা করে আর কয়েক সপ্তাহের বেশি ক্ষমতায় থাকা যাবে বলে মনে হয় না।
বলাবাহুল্য এবং স্পষ্টত, ১৪ দলের নেতারা সেটা মনে করেন না। তবু আশা করব, দেড় শতাধিক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার পর তাঁদের উপলব্ধি হবে যে তাঁরা কতটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
আর আমরা- আমাদের নাম হলো ‘দেশের জনগণ’-শান্তি চাই। আমরা শান্তি চাই লক্ষ্মীপুরে, শান্তি চাই সাতক্ষীরায়। ভয় পাচ্ছি, আগামী দুই সপ্তাহে লক্ষ্মীপুর আর সাতক্ষীরা চলে আসবে ঢাকায়। চলে যাবে সিলেটে, টাঙ্গাইলে, বরগুনায় অর্থাৎ দেশের আনাচে-কানাচে। সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। বাকি এক সপ্তাহ। সবচেয়ে ভালো হয় বিজয় দিবসেই যদি সমঝোতার ঘোষণা আসে।
জাতীয় সংসদের দশম নির্বাচন আগামী নতুন বছরের প্রথম তিন-চার মাসের মধ্যেই করতে হবে, ৫ জানুয়ারির তারিখ বাতিল করে। সবাইকে নির্বাচনে আসতে হবে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের জন্য ‘অভিনন্দন’ পাওয়া যায়, কিন্তু জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও সমর্থন পাওয়া যায় না। জনগণের সমর্থন ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে দেশ চালানোর চেষ্টা করে একমাত্র স্বৈরাচারীরা। তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সেটা বাংলাদেশে আর সম্ভব নয়।
বিরোধী দলকে উন্মুক্ত রাজনীতি করতে দিতে হবে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বিএনপির অফিসের তালা খুলে দিতে হবে। ১৭ তারিখে তাদের ঢাকায় সমাবেশ-মিটিং-মিছিল করতে দিতে হবে। অধমের দৃঢ় বিশ্বাস, তাহলে বিএনপি ১৮ তারিখ থেকে অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করবে। তারপর আলোচনা চলবে এ বছরের শেষ দিন পর্যন্ত, যাতে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিল-তক আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন পেতে পারি।
সেসব কথা পরে হবে। প্রাথমিক সমঝোতা ঘোষণা করুন বিজয় দিবসে। না হলে সবার জন্যই দেরি হয়ে যাবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীরা না ফেরার দেশে নিশ্চয় ভালো আছেন, শান্তিতে আছেন।
ড. শাহদীন মালিক
আইনজীবী
সুপ্রিম কোর্ট এবং
অধ্যাপক,
স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।