| রবিবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৭ | প্রিন্ট
একসময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্দান্ত কৌতুকঅভিনেতা একাধারে টিভি নাটক এবং মঞ্চের শক্তিমান অভিনেতা তিনি। ৭০ দশক থেকে তাকে পর্দায় দেখেছেন দর্শকরা। এ যাবৎ অসংখ্য চলচ্চিত্র-নাটকে নানা ধরনের চরিত্রে তার দুর্দান্ত অভিনয় দর্শকের মনে দাগ কেটে আছে দারুণভাবে। নিজের অভিনয় শৈলি দিয়ে দর্শকদের বিনোদন ও হাসিতে সারাক্ষন মাতিয়ে রাখতেন টেলিসামাদ।
একসময় কমেডিয়ান বললেই চলে আসত তাঁর নাম। সমানতালে অভিনয় করেছেন সিনেমায়, টেলিভিশনে। পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়তা। সবাইকে হাসিয়েছেন যিনি, জীবন সায়াহ্নে এসে অভাব- জরা- ক্লান্তি আর একাকীত্ব মিলিয়ে দারুন অবসাদগ্রস্থ সেই কৌতুক সম্রাটের মুখেই নিভে গেছে হাঁসি।
নজরুল ইসলামের পরিচালনায় ১৯৭৩ সালের দিকে ‘কার বৌ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে এই অঙ্গনে পা রাখেন এই অভিনেতা। তবে তিনি দর্শকদের কাছে যে ছবিটির মাধ্যমে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন সেটি হলো ‘পায়ে চলার পথ’। এরপর অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের বাইরে ৫০টির বেশি চলচ্চিত্রে তিনি গানও গেয়েছেন। বর্তমানে এই অভিনেতা অসুস্থ হয়ে ঘরে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন পর বিনোদন সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে নিজের প্রতিক্রিয়ায় এই অভিনেতা জানান, ‘আশির দশকে যখন চলচ্চিত্রের রমরমা অবস্থা ছিল, তখন আমি দাপিয়ে কাজ করেছি। তবে আমাদের ওই সময়ে এখনকার মতো এতো দ্রুত ছবির কাজ শেষ হতো। একটা ছবির কাজ শেষ করতে ৬-৮ মাস সময় লাগতো। ভক্তি করতে কাজ করতে হতো। আমার মনে আছে, প্রয়াত বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে একটি ছবিতে অভিনয়ের জন্য আমাকে ৯০ বার শট দিতে হয়েছিল। আর এখন শুনি এক মাসেই ছবির কাজ শেষ হয়ে যায়।’
বর্তমান ছবি সম্পর্কে ঢাকাই ছবির শক্তিমান অভিনেতা টেলি সামাদের প্রশ্ন, ‘এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে ছবির কাজ শেষ হওয়া সম্ভব?
প্রায় ছয় শতাধিক ছবিতে কাজ করা এই অভিনেতা বলেন, ‘এটা সত্যি যে আগের চেয়ে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বেড়েছে। কিন্তু একটা ছবির কাজ করতে গেলে, সেই চরিত্রে ঢুকতে গেলে সেটা নিয়ে স্টাডি করতে হয়। আমাদের সময়ে এটা করতাম। কিন্তু এখন কেউ করে না বললেই চলে! সে কারণে অনেকের অভিনয় হয় না।’
নিজের অবস্থা সম্পর্কে দুঃখ করে টেলিসামাদ জানান আমি ভালো নেই। এখন কথা বলতেও কষ্ট হয়। দিনের পর দিন অসুস্থ হয়ে ঘরেই দিন কাটছে আমার। দুই বছর আগে অনিমেষ আইচের ‘জিরো ডিগ্রি’ ছবিতে সর্বশেষ কাজ করেছিলাম।
বেশ অভিমান ও কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন এই অভিনেতা। অভিনয়ের বাইরে লেখালিখি, গান ও ছবি আঁকার প্রতিও প্রবল ঝোঁক রয়েছে টেলিসামাদের। কয়েকদিন আগে নিজেই একটি নাটক নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের কাহিনী নিয়ে একটি নাটক নির্মাণের কথা ভেবেছিলাম। তবে শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য আর কাজটা করা হয়ে ওঠেনি। সামনে কোনো ছবিতে দেখা যাবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বয়স হয়েছে, শরীর নিয়ম অনুযায়ী দুর্বল হয়েছে। যে কারণে চাইলেও আগের মতো যাতায়াত করতে পারি না। এরপরও একটু সুস্থ বোধ করলেই এফডিসিতে যেতে ইচ্ছে করে আমার। সেখানে গেলে পুরানো দিনের অনেক কথা মনে হয়। প্রায় ছয় শতাধিক ছবিতে আমি কাজ করেছি। জীবনের সময় কত দ্রুত চলে গেল টেরই পেলাম না।
অসুস্থতার পর চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আর্থিক অনুদানের পর ২০১৪ সালের ২০ মে আমেরিকায় যান টেলিসামাদ। দীর্ঘ চার মাস নিউ ইয়র্কে অবস্থান করার পর ২৫শে সেপ্টেম্বর দেশে ফিরেন। এরপর ২০১৫ সালের অক্টোবরে তার পায়ের বুড়ো আঙুলে একটি ক্ষত দেখা দেয়। ওই বছরের ১৮ই অক্টোবর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন ঠিকই কিন্তু শারীরিকভাবে আর সুস্থ হতে পারেননি।
আলাপকালে আক্ষেপ ফুটে উঠে অসুস্থ্য এই অভিনেতার চোখে মুখে । টেলি সামাদ বলেন, ‘সবাই এখন টাকার পিছনে ছুটছে। কীসের শিল্প, কীসের আর্ট! ফেসবুকে খোলামেলা ছবি প্রকাশ করে আলোচনায় আসছে, তারকা খ্যাতি, গাড়ি-বাড়ি হাঁকাতে চাচ্ছে! দিন শেষে দেখা যাচ্ছে এরা হারিয়ে যাচ্ছে। সে কারণেই আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এত সংকট। পত্রপত্রিকার মারফাত জানছি, এখন এক নায়কনির্ভর আমাদের ইন্ডাস্ট্রি। একজন নায়ক কখনও একটা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। তাই আমাদের শিল্পী দরকার। এছাড়া আমি মনে করি আমাদের সিনিয়র শিল্পীদের আবার চলচ্চিত্রে নিয়মিত কাজ করা উচিত। তারা ফিরলে চলচ্চিত্রের অনেক সংকট দূর হবে।’
ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় চলচ্চিত্রের পিছনে ব্যয় করেছেন। অভিনেতা দিলদারের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেছেন টেলি সামাদ। কিন্তু এখন চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনয় শিল্পীর সংকট। এই বিষয়টি কীভাবে দেখেন? টেলি সামাদ বলেন, ‘আমি মনে করি কৌতুক পরিবেশন সৃষ্টিশীল একটা কাজ এবং সবচেয়ে কঠিন। এই কঠিন কাজটি দর্শকদের কাছে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে হবে, সুতরাং হাস্যরসের সহজাত একটা ক্ষমতা শিল্পীর থাকতে হবে। যিনি তার চোখ-মুখ, হাত-পা, বক্তব্য, আঞ্চলিকতা- এগুলোর ব্যবহার সঠিকভাবে করতে পারবেন তিনি সফল হবেন।’
টেলি সামাদ একসময় তুমুল ব্যস্ত ছিলেন অভিনয়ে। কিন্তু এখন আর কোনো ছবিতে কাজ করছেন না। তার অভিনীত সর্বশেষ ছবি মুক্তি পায় ‘জিরো ডিগ্রী’ (২০১৫)। সারাদিন বাসায় থাকেন। টিভি দেখেন, ছবি আঁকেন।
আগামীতে কোনো ছবিতে দেখা যাবে কি না তিনি বলেন, ‘বয়স হয়েছে, শরীর নিয়ম অনুযায়ী দুর্বল হয়েছে। যে কারণে চাইলেও আগের মতো যাতায়াত করতে পারি না। এরপরও একটু সুস্থ বোধ করলেই আড্ডা দিতে চলে আসি। জায়গাটা দেখলেই মনে হয় আগের দিনের কথা, অনেক ভালো লাগে। শরীর ভালো থাকলে প্রতিদিনই আসতাম। আর নতুন ছবিতে কাজ না করার কারণও এই একটাই। অনেকেই তাদের ছবিতে কাজের বিষয়ে বলে, কিন্তু শরীর দুর্বল, তাই সাহস পাই না। শুধু মনের জোর দিয়ে তো আর কাজ করা যায় না।’
টেলিসামাদ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা অনেক আগের কথা। বিটিভির ক্যামেরাম্যান মোস্তফা মামুন ভাই এ নামটা দিয়েছিলেন। বিটিভি থেকে একদিন আমার বাসায় চিঠি আসলো আমাকে সেখানে যেতে হবে। সেখানে উপস্থিত হতেই মামুন ভাই বললেন, তোমার নাম আজ থেকে আবদুস সামাদ বাদ দিয়ে টেলিসামাদ। সেই থেকেই আমি হয়ে গেলাম টেলিসামাদ। আরো অনেক কথা জমা আছে টেলিসামাদের মনে। তবে বার বারই বলছিলেন, কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে। শেষের দিকে ভেজা চোখে অস্ফুস্ট কন্ঠে জানালেন, ‘ আর কথা বাড়াতে চাই না। আমার জন্য দোয়া করবেন। আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইছি।
Posted ০৮:১২ | রবিবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৭
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Athar Hossain