| সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ | প্রিন্ট
স্বাধীনদেশ : স্বাধীনতা অর্জনের পর ৪২ বছরে এসে নীরবে-নিভৃতে হারিয়ে গেছেন বীরাঙ্গনা নারীর অনেকেই। অথচ সিরাজগঞ্জে ২০ বীরাঙ্গনা নারী এখনও বেঁচে রয়েছেন নির্মম ইতিহাসের সাী হয়ে। তাদের ভাগ্যে জোটেনি কিছুই। এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা শব্দটিও যোগ হয়নি এসব বীরাঙ্গনার নামের পাশে।উল্টো সমাজ-সংসারের কাছ থেকে অনেকের ভাগ্যে জুটেছে বঞ্চনা, হয়রানি আর নির্যাতন।
সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাড়ে পাশাপাশি টিনের দুটি ছাপড়া ঘরে এখন বসবাস করেন রাহেলা ও মাহেলা। যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর বীরাঙ্গনা নারী পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ১৮ বছরের রাহেলা ফিরে পান তার পুরনো সংসার এবং ১৬ বছরের মাহেলার হয় নতুন সংসার। তবে সামাজিক প্রোপট লোকলজ্জা এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের সন্তানদের।
বীরাঙ্গনা মায়ের সন্তান হওয়ার কারণে রাহেলার দুই মেয়ের সংসারে চলছে টানাপড়েন। বড় মেয়ের সংসার ভেঙেছে; মেজটির স্বামী খোঁজ নেয় না বেশ ক’বছর, যা দেখে তার ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সুমির একটাই দাবিথ ‘আমারে যেন একটি চাকরি দেওয়া হয়।’ অভাব-অনটনে জর্জরিত মাহেলা বলেন, কত অভাব। কত মানুষ আইল, কিন্তু পরে কেউ একটু খোঁজ নেয় না।’ রাহেলা বেগম বলেন, বঙ্গবন্ধুর পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৩৬ বারীঙ্গনা আশ্রয় নিলেও প্রকৃত অর্থে এর সংখ্যা ছিল অনেক। তাদের অনেকে এখনও বেঁচে আছেন। কিন্তু তারা লোকলজ্জায় পরিচয় দিচ্ছেন না। আমরা যারা মুখ খুলেছি, তাদের কিছু হলে তখন সবাই মুখ খুলতে পারে।
বীরাঙ্গনারা জানান, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সিরাজগঞ্জ শহর দখল করে নেয়। শহর দখল করেই চালায় নারকীয় তাণ্ডব। পুরো শহরটি জ্বালিয়ে দেয়। শহর ও শহরতলির মানুষ প্রাণের ভয়ে আশ্রয় খুঁজতে থাকে। সাধারণ জনগণ বাড়িঘর ছেড়ে শহরের উপকণ্ঠ রানীগ্রাম, শৈলাবাড়ি, ঘুরকা, শিয়ালকোলসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের নিয়ে গ্রামগুলোতে হানা দেয় এবং নারকীয় তাণ্ডবের পাশাপাশি গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ লুটপাট চালায়।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ড. নীলিমা ইব্রাহীমের নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করা হয় নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ শুরু সেই সময় থেকেই। পরবর্তী সময়ে সরকারের প থেকে কোনো উদ্যোগ না থাকলেও বেসরকারি সংগঠন সিরাজগঞ্জ উত্তরণ মহিলা সংস্থা এসব নির্যাতিত নারীকে লালন ও তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জেলার ৩৬ বীরাঙ্গনার মধ্যে ১৬ জন মারা গেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানীর নেতৃত্বে পরিচালিত সংস্থাটির ছায়াতলে বর্তমানে রয়েছেন ২০ বীরাঙ্গনা। তারা হলেন, মনি সাহেবের ঘাট ওয়াপদা ঢালের অয়মনা বিবি, কালিয়াহরিপুর গ্রামের আছিয়া বেগম, হাজেরা খাতুন, নতুন ভাঙ্গাবাড়ি রহমতগঞ্জের আয়শা ও সূর্য বেগম, রানীগ্রামের আছিয়া বেগম, তেঁতুলিয়া বনবাড়িয়া গ্রামের করিমন ও জয়গুন বেগম, বিন্দুপাড়া দত্তবাড়ির কমলা বানু, সয়াধানগড়ার জোসনা ও নূরজাহান বেগম, সয়াধান পূর্বপাড়ার মাহেলা, কান্দাপাড়া ফকিরপাড়ার হামিদা খাতুন, কাজীপাড়া গ্রামের হাসিনা বেগম, সয়াধানগড়ার রাহেলা ও শামসুন্নাহার, কামারখন্দ গ্রামের রাজুবালা, চকদেবদাসপাড়ার রহিমা বেওয়া, শহরতলির নদীর কোজার সংলগ্ন সামিনা বেগম, পিটিআই স্কুলপাড়ার সুরাইয়া বেগম। সহায়-সম্বলহীন অধিকাংশ বীরাঙ্গনা অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন।
বীরাঙ্গনা শামসুন্নাহার বলেন, ‘বিয়ের মাত্র তিন মাস পর দেশে যুদ্ধ বাধে। আর যুুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তার চোখের সামনে দুই সারিতে ৮০ মুক্তিযোদ্ধাকে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এরপর বর্বরোচিত নির্যাতন নেমে আসে তার নিজের ওপর।
রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা শুধু ধর্ষণ নয়, শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে যায় নদীর ধারে।’ সয়াধানগড়ার আরেক বীরাঙ্গনা জোসনা বেগম। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে কষ্টের কথা সারা জীবনেও ভুলতে পারব না। আমরা তো সব দিক দিয়ে কষ্ট করতাছি। আমাদের কেউ সম্মান দিচ্ছে না। এখন কোনোমতে বেঁচে আছি। নিজের হাতে জান হত্যা করা মহাপাপ…।’ নূরজাহান জানান, বীরাঙ্গনাদের জাতির কাছে চাওয়া খুব বেশি কিছু নয়। নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, তখন বীরাঙ্গনাদেরও স্বীকৃতি দেবেন এটাই জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একমাত্র চাওয়া। মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিলেও ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট তিনি ঘাতকদের হাতে নিহত হলে বীরাঙ্গনারা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, যে কোনো যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি তি হয় নারীদের। তারা যুদ্ধে স্বজন হারিয়ে যেমন শোকে মুহ্যমান হন, তেমনি বড় বেশি লজ্জা-গ্গ্নানিতে পড়েন যখন তারা যুদ্ধে নির্যাতিত হয়ে বেঁচে যান। কারণ নারীর সম্ভ্রমহানির বেদনা তাকে সারা জীবনই কুরে কুরে খায়। তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বীরাঙ্গনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ এখনও আছে। আমরা ২২ বছর ধরে সরকারের কাছে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান। আশা করি সরকার বিলম্বে হলেও বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দেবে। তা না হলে বাঙালির গৌরবগাথা কখনোই পরিপূর্ণ হবে না।
Posted ২০:০৫ | সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin