মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা জানালেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। শোকের সাগরে ভাসমান মায়েদের বুকে জড়িয়ে ধরে সমবেদনা জানালেন তিনি। সেখানে আয়োজিত শোকসভায় যোগ দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আমি একজন মা হিসেবে আপনাদের শোকের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে এসেছি। এ শোকে কেবল আপনারাই নন, সারাদেশ শোকগ্রস্ত। আমি আপনাদের পাশে আছি।
গতকাল বিকালে মিরসরাই পৌঁছে প্রথমেই তিনি ছুটে যান শোকাভিভূত গ্রামের নিহত পরিবারের সদস্যদের পাশে। সেখানে পৌঁছলে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মিরসরাইয়ের পূর্ব মায়ানি গ্রামের বৃদ্ধা রহিমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। এভাবে আরও অনেক সন্তানহারা মা-বাবা ও প্রিয়জনকে সমবেদনা জানান তিনি। শোকে বিহ্বল কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। নিহতদের পরিবারের প্রতিটিকে ২৫ হাজার টাকার চেক এবং আহতদের পরিবারকেও বেগম জিয়া আর্থিক সহায়তা করেন। এভাবে ৬০টি পরিবারকে সহযোগিতা দেয়া হয়।
বিকালে মিরসরাইয়ের আবু তোরাব উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় বিএনপি আয়োজিত এক শোকসভায় যোগ দেন বেগম জিয়া। এতে হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের শোককে ভাগাভাগি করে নেয়।
খালেদা জিয়া বলেন, এ শোকের কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এটা কেবল মিরসরাইয়ের মানুষের শোক নয়, সারা বাংলাদেশই শোকে মুহ্যমান। এ শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। নিহত পরিবারের অন্য ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে হবে। যারা চলে গেছে, তাদের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
১৯৯৬ সালে মিরসরাই আসনের সংসদ সদস্য খালেদা জিয়া বলেন, একসময় আপনাদের সংসদ সদস্য ছিলাম আমি। তাই যখনই শুনেছি এরকম দুর্ঘটনার কথা, তখনই আপনাদের পাশে এসে সান্ত্বনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
একজন মা হিসেবে খালেদা জিয়া বলেন, আমারও দুই ছেলে আছে। তারা আজ অসুস্থ হয়ে বিদেশে চিকিত্সা নিচ্ছে। তাই ছেলে হারানোর বেদনা আমি বুঝি। ছেলেহারা বাবা-মায়ের কত কান্না—তা আমিও অনুধাবন করি। এজন্য আজ আপনাদের পাশে ছুটে এসেছি।
বিএনপি চেয়ারপার্সন জানান, যারা ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে আছে, দলের ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান তাদের চিকিত্সার ব্যয়ভার বহন করবেন। পরে নিহত ও আহত ৬০ পরিবারের সদস্যদের আর্থিক অনুদান তুলে দেন খালেদা জিয়া।
মিরসরাই উপজেলা বিএনপি সভাপতি রুহুল আমিনের সভাপতিত্বে শোকসভায় আরও বক্তৃতা করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সহ-সভাপতি এম মোরশেদ খান, ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, আবদুল্লাহ আল নোমান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াস কাদের চৌধুরী, স্থানীয় বিএনপি নেতা অধ্যাপক কামাল উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বিএনপি সহ-সভাপতি সেলিমা রহমান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রুহুল আলম চৌধুরী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব আমানুল্লাহ আমান, সালাউদ্দিন আহমেদ, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, চট্টগ্রামের সিটি মেয়র মঞ্জুর আলম, সংসদ সদস্য হারুন অর রশীদ, জয়নুল আবেদিন (ভিপি জয়নাল), বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি এসএম ফজলুল হক, শহীদুল ইসলাম বাবুল, আবদুল লতিফ জনি, শামীমুর রহমান শামীম, বেলাল আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
শোকসভার আগে পূর্ব মায়ানি গ্রামে দুর্ঘটনায় নিহত স্কুলছাত্র শামসুদ্দিনের মা রহিমা বেগমের পাশে গিয়ে খালেদা জিয়া তাকে সমবেদনা জানান এবং সান্ত্বনা দেন। হাতে তুলে দেন নগদ আর্থিক সাহায্য। বেগম জিয়া বলেন, বিএনপি সব সময় আপনাদের পাশে আছে, আগামীতেও থাকবে। ওই গ্রামে বেগম জিয়া ৫-৬টি পরিবারের সদস্যের সঙ্গেও কথা বলেন এবং তাদের পরিবারের খোঁজ-খবর নেন।
পূর্ব মায়ামি গ্রামের নিহত সাজেদুল ইসলামের মা আয়শা খাতুন খালেদা জিয়াকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বেগম জিয়া তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, আমি আপনাদের পাশে থাকব। আপনি একা নন।
নিহত স্কুলছাত্র সাখাওয়াতের মা ফিরোজা বেগম ছেলের নিহত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, আমি একা, আমার পোলাটা নাই। খালেদা জিয়া শোকাগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা জানান এবং তাদের কষ্টের কথা শোনেন।
এর আগে খালেদা জিয়া মিরসরাই উপজেলার সৈদালি গ্রামে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। খাদের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে নিহত স্কুলছাত্রদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং স্থানীয় গ্রামবাসীর কাছ থেকে দুর্ঘটনার বর্ণনা শোনেন, যেখানে গত সোমবার দুপুরে একটি ট্রাক রাস্তার পাশে ডোবায় পড়ে গেলে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়। মিরসরাই স্টেডিয়ামে স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা দেখে বাড়ি ফিরছিল তারা।
এর আগে বেগম জিয়া সকালে গুলশানের বাসা থেকে সড়কপথে মিরসরাইয়ের উদ্দেশে রওনা হন। দুপুরে যাত্রাবিরতি করেন ফেনী সার্কিট হাউসে। মিরসরাইয়ের পথে কুমিল্লার বিশ্বরোড আলেখারচর এলাকায় মহাসড়কে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে হাজার হাজার নেতাকর্মী খালেদা জিয়াকে ফুল ছিটিয়ে অভিনন্দন জানান। এছাড়া যাত্রাবাড়ী, দাউদকান্দি, গৌরীপুর, কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রাম ও ফেনীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানান। তিনি গাড়ি থেকে কর্মীদের অভিনন্দনের জবাব দেন।