নিজস্ব প্রতিবেদক | শনিবার, ০৪ মে ২০২৪ | প্রিন্ট
সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র তাপদাহে জ¦লছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ। দীর্ঘ ৫০ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙ্গেছে ৩০ এপ্রিলের তাপমাত্রা। এ অবস্থা উত্তরণে নিরুপায় মানুষ আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করছেন। আল্লাহ তায়ালা অচিরেই দেশবাসীকে অসহ্য তাপদাহ থেকে মুক্তি দিবেন এ প্রত্যাশা সবার। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। দু’টি সিটি কর্পোরেশনের নগরী ঢাকা একটি মেগা সিটি। আয়তন অনুযায়ী ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা অনেক বেশী। ৩৬০বর্গ কিলো মিটারে বাস করে প্রায় ২ কোটি মানুষ। এছাড়া কর্মস্থল হিসেবে আশেপাশের লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন ঢাকায় আসা যাওয়া করছেন। ঐতিহ্যবাহী নগরী ঢাকা দেশের প্রাণ কেন্দ্র। কিন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা মহানগরী। রাজধানী ঢাকার কিছু সমস্যা আমাদের সামনে আনা প্রয়োজন।
১। মশার উপদ্রব: নগরবাসীর সাধারণ ও অতিপুরাতন একটি সমস্যা হচ্ছে মশার উপদ্রব। সিটি কর্পোরেশ দ্বয়ের পক্ষ থেকে কোটি কোটি টাকা বাজেট ছাড়ের পরেও মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সম্প্রতিক বছরগুলোতে এডিস মশার আক্রমনে ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে শত শত নাগরিকের মৃত্যু নিয়মিত বাৎসরিক আতঙ্কে পরিনত হয়েছে। ২। তীব্র যানজট: প্রায়ই তীব্র যানজটে নগর জীবন স্থবির হয়ে পরে। মানুষের হাজারো কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে যানযটে। এ অবস্থা কিছুতেই নিরসন করা যাচ্ছে না। অনেক সময় ২০ মিনিটটোর ভ্রমণ ৩ ঘন্টায়ও সমাপ্ত হয়না। যানজটের কারণে অনেক সময় রোগী নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছতেও দুর্ভোগে পরতে হয়। সম্প্রতি চালু হওয়া মেট্রো রেলে মিরপুর মতিঝিল রুটে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। উড়াল সেতুতে উড়াল দিয়ে প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক যেখানে নামে সেখানে তীব্র যানজট লক্ষ করা যায়।
৩। ঘন ঘন অগ্নি দুর্ঘটনা: ঢাকা শহরের বিভিষিকাময় অগ্নিকান্ডের ঘটনা লেগেই আছে। নীমতলী (২০১০), চুড়িহাট্টা (২০২৯) ও বনানীর এফআর টাওয়ারের (২০১৯) পর ঢাকা ট্র্যাজেডির খাতায় নতুন করে নাম লেখালো বেইলি রোড অগ্নিকান্ড (২০২৪)। বঙ্গবাজার (২০২৩) ও নিউমার্কেটে (২০২৩) আগুনে হাজারো ব্যবসায়ী সর্বশান্ত হয়ে যান। প্রতিটি অগ্নি দুর্ঘটনার পর হৃদয়বিদারক আবহের সৃষ্টি হলেও আস্তে আস্তে সবাই ভুলে যায় পরে আবার আরেকটি অগ্নি ট্রাজেডির সৃষ্টি হয়। ৪। জলাবদ্ধতা ও ড্রেনেজ সমস্যা: একনাগারে ঘন্টাখানেক মুষধারে বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে যায়। ড্রেনেজ সমস্যার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রæত নি:স্বরণ হতে না পারায় এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এ সমস্যা নিরসনে এখন পর্যন্ত সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
৫। জ¦ালানী গ্যাসের স্বল্পতা: ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা-বাড়ীতে চুলায় গ্যাস সংকটের দীর্ঘ দিনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। বাসা-বাড়ীতে রান্নার গ্যাস পাওয়া যায় না কিন্ত্র মাস শেষে গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হয় ঠিকই। ৬। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ/ স্থাপনা বিস্ফোরণ: বাসা বাড়ীতে নতুনকরে গৃহস্থলীর গ্যাস সরবরাহ না দেয়ায় গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বেড়েছে। একই সংগে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্যাস সিলিন্ডর দুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণ, যা ঢাকা শহরের মানুষের অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সম্প্রতি ভবন বা স্থাপনা বিস্ফোরেণের কয়েকেটি ঘটনায় নগরবাসী আতঙ্কিত হয়ে পরেছেন। মগবাজার ওয়্যারলেস গেইট সংলগ্ন একটি ভবন বিস্ফোরণ (২০২১), সিদ্দিকবাজারে বিল্ডিং বিস্ফোরণ (২০২৩) এক অভাবনীয় আতংকের সৃষ্টি করেছে।
৭। গণপরিবহন সংকট: অফিস টাইমে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসের সময়ে গণপরিবহনের সংকটে শিশু, নারী, বয়োবৃদ্ধ, অফিসগামী মানুষের কষ্টের শেষ নেই। আর পরিবহন খরচতো বেড়েই চলছে। ৮। পানি সংকট: নগরির বিভিন্ন এলাকায় প্রায়শ্চই পানির অভাবে পরতে হয় নগরবাসীকে। ওয়াসার পানি পানোযোগী নয়। সম্প্রতি সার ঢাকায় রাবারের নতুন পানির লাইন স্থাপন করা হলেও পানিতে দুর্গন্ধ বেড়েছে। ফুটিয়েও দুর্গন্ধমুক্ত হচ্ছে না লাইনের পানি। বিভিন্ন এলাকায় কার্ডের মাধ্যমে ওয়াসার বিশুদ্ধ পানি বিক্রির ব্যবস্থা একটি জনবান্ধব উদ্যোগ।
৯। অপরিকল্পিত নগরায়ন/ ঝুকিপূর্ণ ভবন: অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের ফলে ফলে নগরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অপ্রত্যাশিত নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে শহরাঞ্চলে বেকারত্ব, পরিবেশের অবনতিসহ আরও বহুমাত্রিক সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এসব সমস্যা সমাধানে সঠিক পরিকল্পনার পাশাপাশি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের হিসেব মতে, ঢাকায় অগ্নিঝুঁকিতে আছে এরকম ভবনের সংখ্যা ২ হাজার ৬০০ টিরও বেশি। তবে সংখ্যাটা বাড়বে আরো বেশি হবে কারণ খোদ ফায়ার সার্ভিস বলছে ঢাকার সবগুলো ভবন তাদের জরিপে আসেনি (বিবিসি)। ঢাকায় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ ব্যাহত হচ্ছে বিভিন্ন কারণে।
১০। ভূমিকম্পের আশংকা: মাঝে মাঝেই স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকা মহানগরীকে প্রকম্পিত করে। কিন্তু কখনো ভূমিকম্পের মাত্রাা তীব্র হলে অপরিকল্পিত নগরায়নের মেগাসিটি ঢাকা নগরীর যে কি অবস্থা হতেপারে তা চিন্তা করে অনেকেই শিউরে উঠেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ বা এর আশেপাশের অঞ্চলে প্রতি দেড়শ বছরে সাত বা তারচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। সেই হিসাবেও বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
১১। খাদ্যে ভেজাল: ভেজাল খাদ্য দ্রব্য নাগরিক জীবনের বড় একটা সংকট। অতিলোভে এক শ্রেণীল মানুষ খাদ্যে ভেজাল, বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে রাজধানীতে এনে নাগরিকদের কাছে বিক্রি করছে। এসব ভেজাল খাদ্য ভক্ষণ করে নাগরিকগণ শারিরীক অসুস্থতা ও স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে পতিত হচ্ছে। ১২। নিয়মিত খোড়াখুড়ি: ঢাকা মহানগরীতে নিয়মিত খোড়াখুড়ি একটা বড় সমস্যা। পানির লাইনের জন্য রাস্তা খোড়ার পর গ্যাসের লাইন। এরপর দেখা যায় সুয়ারেজ লাইন মেরামত ইত্যাদি। উন্নয়নের নামে রাস্তা ঘোড়াখুড়িতে নিয়মিত ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। এতে নগরবাসির যেমন কষ্ট হয় তেমনি পরিবেশও দুষিত হয়। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এ খোড়াখুড়ি লেগেই থাকে।
১৩। মাটি ও বৃক্ষমুক্ত ঢাকা: একটি শহরের বসবাসের যোগ্য হতে বৃক্ষ আচ্ছাদিত বা সবুজ এলাকা কম করে হলেও ১৫ শতাংশ প্রয়োজন। কিন্তু এখন ঢাকা প্রয়োজনের অর্ধেক সবুজ এলাকা আছে কিনা অনিশ্চিত। অন্যদিকে গত ২৮ বছরে ঢাকা শহরে কংক্রিটের আচ্ছাদন বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। মাটি শুন্য হয়ে পরছে ঢাকা শহর। মাটি না থাকলে গাছ থাকবে কি করে। মাটি না থাকলে মাটির নিচে পানি আসবে কোত্থেকে। এতে শহরের নিচের পানির স্তর নিচে নেমে যাবে, যা ভুমিকম্প, ভুমি ধ্বসের কারণে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রæত ব্যবস্থা না নিলে ঢাকা শহরের বিপদ আরও বাড়বে। অবিলম্বে দখলকৃত জলাধারগুলো উদ্ধার করতে হবে। বাড়াতে হবে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা। নতুবা আবহাওয়া আরো চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠবে। উচ্চ তাপমাত্রায় থার্মোমিটারের পারদ আরো উপরে উতেই থাকবে। ১৪। উধাও ঢাকার জলাশয়- জলাধার: তীব্র তাপপ্রবাহ যখন বইছে, তখন একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য জলাময়ের পাশে গাছের ছায়া খোঁজেন সবাই। কিন্তু বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তা মেলাই ভার। বৈশ্বিক মানদন্ড অনুযায়ী, একটি শহর বাসযোগ্য রাখতে মোট ভূমির ১০-১২ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়। ৩৬০ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা মহানগরীতে (সিটি করপোরেশন এলাকা ধরে) ১৯৯৫ সালেও মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি জলাভূমি ছিল। কিন্তু তা কমতে কমতে এখন ২ শতাংশের নিচে নেমেছে।
১৫। দুষিত বাতাস – অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ: যানবাহনে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, ক্রমবর্ধমান এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবহার ঢাকার আবহাওয়াকে অস্বাভাবিক দূষিত করে তুলেছে। ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি সকাল ৯টায় বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ২৮০ নিয়ে রাজধানীর বাতাসের মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় ছিলো। একিউআই স্কোর অনুযায়ী ১১ জানুয়ারি ২০২৪ সকালে বিশ্ব তালিকায় ঢাকার অবস্থান শীর্ষে। (ডেইলিস্টার অনলাইন)
দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণে ভুগছে ঢাকা। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার বায়ু দূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুসারে, বায়ু দূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৬। জীবনধারণের অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি: ঢাকা মহানগরীতে দিন দিন বাসা ভাড়া, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, উচ্চ পরিবহন খরচ, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, উচ্চ হোল্ডিং ট্যাক্স, উচ্চ চিকিৎসা খরচ ইত্যাদি নগরবাসীকে বিশেষকরে স্বল্প আয়ের নাগরিকদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।
এছাড়া বিভিন্ন ফুটপাথ দখল করে ব্যবসায়-বাণিজ্য, নগরীতে ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা, অফিস-আদালতে ঘুষ- দুর্নীতি, শিশু- কিশোরদের খেলাধুলার মাঠের অভাব, মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি, ছিনতাই- চুরি, কিশোর গ্যাং, মাস্তানী- চাঁদাবাজী নগর জীবনের অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ঢাকা মহানগরীর মত এর পার্শবর্তী সাভার, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জেও এসব সমস্যা সমভাবে প্রতিয়মান হচ্ছে। এ সব সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সচেতনতা, আন্তরিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা একান্ত প্রয়োজন। আমর্ াকিছুতেই চাই না অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা একটি পরিত্যাক্ত নগরিতে পরিনত হোক। আমরা চাই প্রাণবন্ত ঢাকা।
লেখক: সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
muaj1975@gmail.com
Posted ১৫:৩৪ | শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin