| রবিবার, ০১ জুন ২০১৪ | প্রিন্ট
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। বিশ্বের প্রায় ১৫০টি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তার গবেষণালব্ধ বিভিন্ন নিবন্ধ। কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন বাংলাদেশের একুশে পদক।
৩০ মে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৩তম শাহাদাতবার্ষিকী। এ দিনটিকে সামনে রেখে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ড. এমাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা হয়। জিয়াউর রহমানের আদর্শ, রাজনীতি, স্বাধীনতার ঘোষণাসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে দেশগঠনে জিয়াউর রহমানের শাসনকালকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আমি জিয়াউর রহমানকে দেখি আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে। কারণ তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে যখন ক্ষমতাসীন হলেন, তখন বাংলাদেশের অবস্থা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভয়ঙ্কর খারাপ। তার এক বছর আগে ১৯৭৪ সালে বহুসংখ্যক লোক না খেয়ে মৃত্যুবরণ করে। বিদেশেও নানা কথা ওঠে। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশেকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি বলে ঠাট্টা-মশকরা করেছিলেন। দেশের অভ্যন্তরের কথা যদি বলি- এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল ভয়ঙ্কর খারাপ। পুলিশ বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। এ বাহিনীকে পরবর্তী সময়ে সুসংগঠিত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জিয়াউর রহমান এ দশা থেকে বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোস্তাক ক্ষমতাসীন হলেন। রাষ্ট্রপতি হলেন। বাকশালকে নিষিদ্ধ করা হলো।এরপর জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণ করলেন । তিনি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন দেশে কোনো রাজনৈতিক দলও ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্থবির। সামরিক বাহিনী ছিল চার ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে দেশের সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় স্বপ্ন দেখছিল। আরেক ভাগ দেশে ইসলামী ব্যবস্থার প্রচলন করার চিন্তা করছিল। এম জি তাওয়াবের নেতৃত্বে এক বাহিনী। আবার এরশাদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি নেতারা সংগঠিত হতে চেয়েছিল সুবিধা নেওয়ার জন্য।
একাকি একটি দেশ। তার পথ ইন্দো-সোভিয়েত কক্ষ পথে ঘোরাফেরা করছে। ১৯৭৭ সালে মাত্র দুই বছরের মাথায় মানে ৭৫ সাল থেকে ৭৭ সালে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় নতুন সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ উদ্ভব হতে যাচ্ছে। ৭৬ সালে পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশন (পিপিআর) এর মাধ্যমে দেশের মৃতপ্রায় রাজনৈতিক দলগুলোকে উজ্জীবিত ব্যবস্থা নেন জিয়াউর রহমান। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাধাহীন সূচনা জিয়াউর রহমানের মাধ্যমেই।
স্বাধীনতার পর নির্বাচন ব্যবস্থা ও রাজনীতি সম্পর্কে বলুন।
৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল কায়েম করে দেশে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে দেশে বাকশালের সে ধারাবাহিকতাই চলছে। ‘৭৫ এ সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর কাজটি করা হয়েছিল নির্বাচনব্যবস্থাকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে। সে সময় বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমনের জন্য নির্মম রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয় এবং নির্বাচন ব্যবস্থা অর্থহীন করা হয়। ১৯৭৩ সালে নিজে জাতীয় সংসদের আয়ু দুই বছর বৃদ্ধি করে ফেলে। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলেন। কোনো নির্দিষ্ট টাইম ছিল না। তিনি নির্বাচিত হলেন, নির্বাচন না করেই। এরপর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের হাতে নির্বাচন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো।
জিয়াউর রহমান কীভাবে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি?
জিয়াউর রহমানই দেশের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। এর আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়নি। ৭৭ সালের প্রথম দিকে স্থানীয় পর্যায়ের নিবার্চন ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নিবার্চন হলো। এরপর ১৯৭৮ সালের ৩ জুন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন জিয়াউর রহমান।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার ওই অর্থে নির্বাচিত নয়। ১০ তারিখে বঙ্গবন্ধুকে প্রেসিডেন্ট করা হয়। তিনি যেহেতু পাকিস্তানের জেলে ছিলেন। এ জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। তিনি বাংলাদেশে ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ১১ তারিখে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হলেন। ১২ তারিখে রাষ্ট্রপতি হলেন বিচারপ্রতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সুতরাং প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা আছে। তার এ ঘোষণাকে কীভাবে দেখছেন?
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ যখন জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, তখন তিনি নিজেকে প্রভিশনার হেড অব দ্য গভর্মেন্ট বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দেন। সুবেদ আলী ভূঁইয়া তার ‘মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস’ (১৯৭২ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম বই) বইতে লিখেছেন, জিয়া যখন কালুরঘাটে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন সেখানে সুবেদ আলী ভূঁইয়া, মীর শওকত আলী, অলি আহমদ উপস্থিত ছিলেন। এদের সামনে তিনি নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন। ২৮ মার্চ তিনি চিন্তা করলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করায় এটার পলিটিক্যাল ক্যারেক্টার ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। হয়ত সামরিক অভ্যুত্থান ঘটল এটা মনে হতে পারে। এ জন্য তিনি অন বিহ্যাভ অব গ্রেট লিডার শেখ মজিবুর রহমান উল্লেখ করেন। ২৮, ২৯, ৩০ মার্চ পর্যন্ত এ ঘোষণা চলে। মেজর রফিক, সফিউল্লাহ তাদের বইতে লিখেছেন এ ঘটনা। এ ছাড়া আরও অনেক প্রমাণ আছে।
জিয়াউর রহমান কি তাহলে স্বঘোষিত প্রথম রাষ্ট্রপ্রতি?
স্বঘোষিত তো বটেই। যেহেতু কোনো পার্টি নেই, কোনো রাজনৈতিক নেতা নেই, সবার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি এ ঘোষণা দেন। এরপর পাকিস্তানিরা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র ভেঙে দেয়। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার। আজকে সূর্যসেন হল তখনকার জিন্নাহ হল। আমি হাউস টিউটর ছিলাম।
২৫ মার্চ রাতে কারফিউ দিয়ে ২৬ মার্চ পুরোপুরি কারফিউ। ২৭ মার্চ বিকাল চারটায় কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। বেতারে আমি জিয়াউর রহমানের ঘোষণা নিজের কানে শুনেছি। আমি বিস্মিত হই। হঠাৎ করে এটা কে! কীভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার দুঃসাহস হলো তার! এটাই হলো জিয়াউর রহমান। পরীক্ষিত জিয়াউর রহমান। এখন কিন্তু মামলা করতে চাইলে তা করার ক্ষমতা কারও নেই। প্রমাণ একটা নয়, অসংখ্য প্রমাণ আছে। তাজউদ্দিন সাহেবের মেয়ের লেখা বইয়ে লেখা হয়েছে, ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দিন সাহেব টেপ রেকর্ডার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি তাকে অনুরোধ করলেন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। কাল কে কোথায় থাকবে, কার কি হবে কেউ জানি না আমরা! অন্তত স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিয়ে যান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলে দিলেন কোনো রেকর্ড রাখতে চাই না। আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হবে। তিনি যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে চাননি এখানে এটা প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর বইয়ের লেখাও তা প্রমাণ করে।
একজন রাষ্ট্রনির্মাতা হিসেবে জিয়াউর রহমানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
একটা কথা মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশ যেভাবে জন্মলাভ করল। পাকিস্তান কিংবা ইন্ডিয়ার জন্ম সেভাবে হয়নি। ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা হয়েছে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ও বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে। অসংখ্য মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। এ মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশেকে ইন্দো-সোভিয়েত কক্ষ পথ থেকে তুলে আনলেন জিয়াউর রহমানই। একই সঙ্গে বিশ্বময় বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। এ জন্য ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর চীন ও সৌদি আরব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, এর আগে তারা স্বীকৃতি দেয়নি। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য মুসলিম দেশও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। চীন, জাপান, ইউরোপ আমেরিকা সবার সঙ্গে সর্ম্পক উন্নয়ন হয়। আজকের অর্থনীতি যে অবস্থায় তাও জিয়াউর রহমানের অবদান। সেই সময় তিনি সৌদি আরবে ১ থেকে দেড় লাখ লোক পাঠিয়ে ছিলেন। এখন সেখানে ২৫ লাখ লোক থাকে। এ ছাড়া শিশু একাডেমি, প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা তিনি নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন। আজকের এ সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল জিয়াউর রহমানকে। তার শত শক্র ছিল, এখনও আছে। তবে তার শক্ররাও বলতে পারবে না তিনি অসৎ ছিলেন। তার জীবনযাপন ছিল সাদামাটা। পাশাপাশি জিয়াউর রহমান স্ট্রেইট ওয়েতে (সোজাসাপ্টা) কথা বলতেন।
কর্নেল তাহেরের বিচার ও হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক আছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
স্বাধীনতার পক্ষে যারা যুদ্ধ করেছেন তারা মুক্তিযোদ্ধা। কর্নেল তাহেরও জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। এক পা হারিয়েছেন। তিনি গ্রেট ফাইটার ছিলেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে, যেভাবেই হোক না কেন একটা বিচার হয়েছে। তবে তার মতো এমন একজন গ্রেট ফাইটার জীবিত থাকলেই আমি খুশি হতাম। এতটুকুই বলতে পারি-এ রকম মুক্তিযোদ্ধার বিচার করার অধিকার কারো থাকা উচিত না।
যারা জিয়াউর রহমানের হাতেগড়া দল বিএনপির দায়িত্ব পালন করছেন, আপনার কী মনে হয় জিয়াউর রহমানের আদর্শকে ধারণ করে নেতারা বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছেন?
নেতারা জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে অনেকখানি সরে গেছেন। সরে যাওয়াতেই এ সমস্যা হয়েছে। দলের মধ্যে ট্রেনিং নেই, সততা নেই, একনিষ্ঠতা নেই। জিয়াউর রহমান বলতেন ‘‘বাংলাদেশে মাটি আর মানুষ তৈরি করতে হবে। মানুষগুলোকে শিক্ষিত করতে হবে। মাটিকে উর্বর করতে হবে।’’ তাই ফসল ফলানোর জন্য ড্রেন, খাল তৈরি করলেন। আজকে বিএনপি এসব অনুকরণ-অনুসরণ করে না বলেই এ অবস্থা, এ দুর্দশা।
দলটির নেতারা টাকা পয়সার প্রতি এত বেশি ঝুঁকে গেছেন, রাজনীতি করতে গিয়ে যা করা উচিত নয় তারা তা করছেন। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে যা দরকার তা হলো জিয়াউর রহমানের আদর্শকে অনুসরণ করা, বাংলাদেশের সবার জন্যই তার আদর্শ অপরিহার্য।
Posted ১০:২২ | রবিবার, ০১ জুন ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin