| মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ ২০২২ | প্রিন্ট
হুমায়ুন কবির, শরণখোলা প্রতিনিধি :
আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে সুন্দরবনে মধু আহরণ। বনবিভাগ মধু আহরণের আগাম সিদ্ধান্ত নিলেও তাতে আগ্রহ নেই পূর্ব সুন্দরবন অঞ্চলের মৌয়ালদের। প্রতিবছর ১এপ্রিল থেকে শুরু হয় মধু আহরণ মৌসুম। কিন্তু, এবছর ১৫ মার্চ থেকেই মধু সংগ্রহের পাসপারমিট দেওয়ার ঘোষনা দিয়েছে বনবিভাগ। তবে, এই তারিখে কোনো মৌয়াল পাসগ্রহন বা বনে যাচ্ছেন না বলে জানা গেছে।
এদিকে, বনবিভাগের এই আগাম সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করে অভিজ্ঞ মৌয়াল ও মধু ব্যবসায়ীরা বলেন, সবেমাত্র বনে ফুল আসতে শুরু করেছে। মৌমাছিরা বাসা তৈরীতে ব্যস্ত। পূর্ণাঙ্গ মৌচাক তৈরী হয়নি এখনো। এই মুহুর্তে চাকে আঘাত লাগলে বা মধু সংগ্রহের জন্য মশাল জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিলে মৌমাছিরা অন্যত্র চলে যাবে। এতে বাসা তৈরী ও চাকে মধু সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হবে মৌমাছিদের। ফলে মৌমাছি-মৌয়াল উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মৌয়ালদের এই যুক্তির সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বনবিভাগ জানায়, সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই এলাকা নিয়ে পূর্ব বনবিভাগ এবং খুলনা ও সাতক্ষীরা নিয়ে হচ্ছে পশ্চিম বনবিভাগ গঠিত। এই দুই বিভাগের বনাঞ্চলের ভৌগোলিকগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। একারণে দুই অঞ্চলে সমগোত্রের গাছপালাও একই রকম জন্মায় না। সুন্দরবনে যে কয়টি প্রজাতির ফুলের মধু পাওয়া যায়, তার মধ্যে খলসি ও গরাণ ফুলের মধু উন্নত মানের। এই দুইয়ের মধ্যে আাগাম ফুল আসা খলসি প্রজাতির গাছ কেবলমাত্র পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা অঞ্চলেই বেশি।সে তুলনায় পূর্ব বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাইতে খুবই কম এই খলসি গাছ। আবার গরাণ গাছের আধিক্য বেশিপূর্ব বিভাগে। এই গরাণের ফুল আসা শুরু হয় মার্চের শেষ দিকে, থাকে পুরো এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এই গরাণ ফুলের মধুও খলসি ফুলের মধুর মতোই উৎকৃষ্ট। যে কারণে পূর্ব বিভাগের মৌয়ালরা গরাণ ফুলের ওপর বেশি নির্ভর করে। খলসি মধু সংগ্রহের জন্যই মূলত আগাম সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বনবিভাগের ঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) থেকে মধু আহরণের পাস দেওয়া শুরু হবে। অথচ এখনো বনে যাওয়ার কোনো প্রস্তুতিই নেননি পূর্ব বিভাগের মৌয়ালরা। মৌয়াল দল গঠন, নৌকা প্রস্তুত বা মহাজনের কাছ থেকে দাদনও নেওয়া শুরু করেননি এখন পর্যন্ত। তারা সবাই বনে মাছ ধরাসহ এলাকায় অন্য কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। মূলত, ১৫ মার্চের পর থেকেই তারা মধু আহরণের জন্য বনে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহন করে থাকেন।
অপরদিকে, গতবারের তুলনায় এবছর রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ। আগে ১৫ দিনে জনপ্রতি রাজস্ব ছিল ৭৫০ টাকা। কিন্তু, এবার সেখানে করা হয়েছে ১৫০০টাকা। এসব কারণে বনবিভাগ আগাম পাস দিলেও চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী ১এপ্রিলের আগে কেউই বনে যাচ্ছেন না বলে মৌয়ালরা জানান।
সম্প্রতি সরেজমিন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার মৌয়াল অধ্যুসিত খুড়িয়াখালী, চালিতাবুনিয়া, বগী, সোনাতলা এবং চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনাধীন উত্তর রাজাপুর ও পশ্চিম রাজাপুরএলাকা ঘুরে ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে সুন্দরবনে মধু আহরণ করছেন এমন অর্ধশতাধিক মৌয়ালের সঙ্গে কথা হয় কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদকের। সরাসরি বনে গিয়ে মধু সংগ্রহকারীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়এই তথ্য।
তবে, বনবিভাগ বলছে, সুন্দরবনে খলিসা প্রজাতির গাছে আগাম ফুল আসে। এই ফুলের মধু দেশে প্রাকৃতিকভাবে আহরিত মধুর মধ্যে সর্বোতকৃষ্ট মানের। দাম এবং চাহিদা দুটোই বেশি। সঠিক সময় এই মধু আহরণ না করায় তা বনের অন্য পেশাজীবীরা চুরি করে নিয়ে যায়। ফলে, প্রকৃত এবং পাসি মৌয়ালরা পর্যাপ্ত খলসি মধু সংগ্রহ করতে পারেন না। এবং এতে বনবিভাগও রাজস্ব বঞ্চিত হয়। যে কারণে এই মধু সংগ্রহের জন্যই আগাম পাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
খুড়িয়াখালী গ্রামের নূর ইসলাম ফরাজী (৬৫), সোবাহান ফরাজী (৪৫), চালিতাবুনিয়া গ্রামের আনোয়ার আকন (৫৫), বগী গ্রামের শাহজাহান হাওলাদার (৫৮), সোনাতলা গ্রামের ফজলু তালুকদারসহ (৬০)অভিজ্ঞ এসব মৌয়ালরা জানান, আগাম পাসে লাভবান হবে পশ্চিম বিভাগের মৌয়ালরা। এই সময় বনে গেলে পূর্ব বিভাগের মৌয়ালদের পুরো একটি মৌসুম (১৫ দিনে এক গোন) লোকসান গুনতে হবে। তাই ১৫ মার্চ পাস গ্রহন করবেন না, ১ এপ্রিল থেকেই বনে যাবেন তারা।
দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞাতা সম্পন্ন এসব মৌয়ালদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, সুন্দরবনের গাছ গাছালিতে সবেমাত্র ফুল আসতে শুরু করেছে। মৌমাছিরাও বাধতে শুরু করেছে তাদের বাসা (মৌচাক)। মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাসা তৈরী করবে মৌমাছিরা। সেই বাসায় ডিম পেড়ে বংস বিস্তারের পাশাপাশি একই সাথে বাসা তৈরীর কাজও চলমান থাকে। এর পর বনের নানা প্রজাতির ফুল থেকে বিন্দু বিন্দু মধু সংগ্রহ করে নেই বাসা বা চাকে জমা করে। পুরো মার্চ মাসই বাসা তৈরী এবং মধু সংগ্রহে পার হয়ে যায়। এপ্রিল মাসের পর থেকেই সেসব বাসা মধু সংগ্রহের জন্য উপযোগি হয়ে ওঠে। চাকের কিছু অংশ রেখে মধু সংগ্রহ করা হয়, যাতে পরবর্তীতে মৌমাছিরা সেখানে আবার নতুন করে বাসা তৈরী করতে পারে।বাসা তৈরীর শুরুতেই যদি চাকে আঘাত বা মধু আহরণের জন্য ধোঁয়া দেওয়া হয়, তখন মৌমাছিরা পূর্ণাঙ্গ বাসা তৈরী করতে পারে না। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তা অন্যত্র চলে যায়। এতে মৌমাছি এবং মৌয়াল উভয়ই ক্ষতিগস্ত হয়।
বনবিভাগের গড় সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক নয় দাবি করে তারা জানান, সুন্দরবনে খলসির ফুল আগে ফোটে ঠিকই কিন্তু, এই প্রজাতি পূর্ব বনাঞ্চলে তেমন একটা পাওয়া যায় না। শরণখোলা রেঞ্জের কোকিলমনি, টিয়ার চর, দুবলার চরের কিছু এলাকায় পাওয়া গেলেও তা সামান্য। এজন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করে অগ্রিম পাস নিয়ে লাভ নেই। এপ্রিলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় গরাণ ফুলের মধু। মে-জুনের দিকে আসে কেওড়া, গেওয়াসহ অন্যান্য প্রাজাতির মধু।
খুড়িয়াখালী গ্রামের মো. রাসেল আহমেদ, জালাল মোল্লা, ফেরদৌস খানসহ কয়েকজন মধু ব্যবসায়ী জানান, আগাম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সুন্দরবনের দুই অঞ্চলের অভিজ্ঞ মৌয়াল ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এবং বনের কোন এলাকায় কোন ফুল বেশি সে বিষয়টি ভালোভাবে খোঁজখবর নেওয়া উচিৎ ছিল বনবিভাগের। মৌসুম শুরু হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। কিন্তুতাদের সঙ্গে কোনো মৌয়াল এখন পর্যন্ত যোগাযোগ করেননি। গত বছরের রেখে যাওয়া বধুর কন্টেইনারও নিতে আসেননি।প্রতি বছরের ন্যায় ১৫ মার্চের পর থেকেই যোগাযোগ শুরু করবেন তারা।
ব্যবসায়ীরা আরো জানান, গেলো বছর অনাবৃষ্টিতে ফুল ফোটার আগেই কলি শুকিয়ে ঝরে গেছে। সে কারণে মধু কম পাওয়া গেছে। দামও ছিল প্রচুর। এবার মৌসুম শুরুর আগেই কয়েকদফা বৃষ্টিপাত হওয়ায় ফুলের লক্ষণ ভালো। গতবারের তুলনায় বেশি মধু পাওয়া যাবে বলে আশা তাদের।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, খলসি ফুলের মধুর ৯০ ভাগই আসে পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে। এই খলসি ফুল মার্চের মধ্যেই চলে আসে। মধুর পাস দেরিতে দেওয়ায় মাছের পাস নিয়ে যারা বনে যান, তারা এই মধু গোপনে আহরণ করেন। ফলে, প্রকৃত মৌয়াল ও বনবিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে বিষয়টি অনুসন্ধান করেই এবছর আগাম পাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পূর্ব সুন্দরবন থেকে এবছর(২০২১-২০২২ অর্থবছর) ১০৫০ কুইন্টাল মধু এবং ৩৫০ কুইন্টার মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এসিএফ জানান, পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কিছু কিছু এলাকার মৌয়াল১৫ তারিখে যাওয়ার প্রস্তুতির খবর শোনা যাচ্ছে। না গেলেও সমস্যা হবে না। আহরণ না করলে সেই মধু চাকেই থেকে যাবে। পরে যখন যাবেন তখন আহরণ করতে পারবেন। আগাম আসা এই মধু যাতে অন্য কেউ অবৈধভাবে আহরণ করতে না পারে, এজন্য স্মার্ট প্যাট্ট্রলিংসহ বনবিভাগের টহল জোরদার করা হবে।
Posted ০৯:১৬ | মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ ২০২২
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Rafiq Masum