| মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৩ | প্রিন্ট
জুলফিকার আহমদ কিসমতি
চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর (রা.) শাসনামল। বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ থেকে আলাদা। একদিন খলিফার একটি বর্ম চুরি হয়ে যায়। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে ওই বর্ম ব্যবহার করেছেন। পরস্পর জানা গেল, জনৈক ইহুদি বর্মটি চুরি করে নিয়ে গেছে। তাকে খলিফার বর্মটি ফেরত দেয়ার জন্য বলা হলো। কিন্তু সে ওটা তার নিজের বলে দাবি করল। খলিফার পক্ষ থেকে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা হলো। ইহুদি নাগরিকটিকে কোর্টে হাজির হওয়ার জন্য বিচার বিভাগ থেকে ফরমান গেল। নির্দিষ্ট তারিখে যথাসময়ে বাদী খোদ খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত আলী (রা.) এবং বিবাদী জনৈক ইহুদি নাগরিক বিচার কক্ষে উপস্থিত। নিজ শাসনাধীন রাষ্ট্রের বিচার কক্ষে খলিফা আলী (রা.) আরও দশজন বিচারপ্রার্থীর মতো বিচারকের সামনে দণ্ডায়মান। বিচারক বাদীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিবাদীর কাছে যেই বর্মটি রয়েছে, সেটা যে আপনার তার সপক্ষে আপনার কী প্রমাণ আছে?’ বাদী খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত আলী (রা.) জবাবে বললেন, ‘আমার বর্মে যেসব চিহ্ন ছিল তার সবগুলোই তাতে রয়েছে। এছাড়া আমি বর্মটি দীর্ঘদিন ব্যবহার করায় তা যে আমার তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমিরুল মুমিনিন, আপনার দাবির সমর্থনে কোনো উপযুক্ত সাক্ষী আছে কি?’ হজরত আলী (রা.) বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমার পুত্রদ্বয় হাসান-হোসাইন এবং খাদেম সাক্ষী রয়েছে।’ বিচারক বললেন, ‘পিতার সপক্ষে নিজ পুত্রের ও খাদেমের সাক্ষী মনীবের সপক্ষে গ্রহণযোগ্য নয় খলিফা!’ তিনি বললেন, ‘মহানবী (সা.) হাসান-হোসাইন সম্পর্কে হাদিসে উল্লেখ করেছেন যে, তারা জান্নাতের যুবকদের নেতা—তাদের বিশ্বস্ততায় সন্দেহের কী আছে?’ বিচারক বললেন, ‘মহানবী (সা.) সেটা পরলোকের ক্ষেত্রে বলেছিলেন। ইহলোকের বিচার ব্যবস্থায় এটাকে নীতিগতভাবে স্বীকার করা যায় না।’ বিচারকের রায় ইহুদির পক্ষে চলে গেল। মুসলিম বিশ্বের শাসক আমিরুল মুমিনিনের দাবি তারই শাসনাধীন আদালতে গ্রাহ্য হলো না। তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে আদালত কক্ষ থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন! এমন সময় বিবাদী ইহুদি ওই বিচারকের সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘হুজুর! আসলে বর্মটি আমিরুল মুমিনিন হজরত আলীরই। এটি আমার বর্ম নয়। মুসলিম বিচার ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্য আমাকে মুগ্ধ করেছে, যে ধর্মে ন্যায়বিচারের প্রশ্নে খোদ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতিও কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই, আমি আজ থেকে সেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী বলে নিজেকে ঘোষণা করছি—আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ। বিচারক বর্মটি হজরত আলীকে (রা.) হস্তান্তর করলেন। ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা বৈশিষ্ট্যের এমন সব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেগুলোর নজির বিশ্ব-ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়।
এ আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে—ইসলামী বিচার ব্যবস্থার এমন একটি দিককে তুলে ধরা যা যে কোনো বিচারেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত, যেই দিকটির অনুপস্থিতিতে বিচারের মূল লক্ষ্যই পণ্ড হয়ে যায়।
নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং কোনো নাগরিকের সম্পদ বা অধিকার অন্যায়ভাবে হরণ করা হলে, সেই সংক্রান্ত বিচারে বাদীর হৃত সম্পদ ও অধিকার তার হাতে ফিরিয়ে দেয়াই হচ্ছে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। তেমনিভাবে বাদী যদি কোনো ব্যক্তিবিশেষ না হয়ে ব্যক্তিসমষ্টি হয় কিংবা হৃত অধিকার বা সম্পদটি জাতীয় সম্পদ বা জাতীয় অধিকার হয়, তাহলে ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় ওই সম্পদ বা অধিকার যথাক্রমে ওই ব্যক্তিসমষ্টির হাতে তুলে দিতে হবে। জাতীয় সম্পদ হলে সেটা জাতীয় তহবিলে গিয়ে জমা হবে। অধিকারের প্রশ্ন হলে বিচার বিভাগ জাতির সপক্ষে সেই অধিকারের কথা ঘোষণা করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক যুগের আইন যা কমবেশি মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে অনেক দেশেই বর্তমানে প্রচলিত রয়েছে, তাতে আইনের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি অনেকাংশে অনুপস্থিত দেখা যায়। বিবাদী হয়তো বাদীর বিপুল অর্থ অন্যায়ভাবে আত্মসাত্ করেছে বা তার কোনো উপার্জনক্ষম নিকটাত্মীয়কে হত্যা করেছে বা অন্য গুরুতর অপরাধ করেছে, সেক্ষেত্রে দেখা যায়, বিচারে বিবাদীকে নির্দিষ্ট মেয়াদের শাস্তি দেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু বাদীর যে সম্পদ খোয়া গেল বা যা ক্ষতিসাধিত হয়ে গেল, তার বিনিময়ে সে কিছুই পেল না। মাঝখানে বরং মামলা-মোকদ্দমায় তাকে শারীরিক-মানসিক ক্ষতি ছাড়াও বিরাটভাবে আর্থিক ক্ষতি বরণ করতে হলো।
বিশেষ করে ব্যাপারটি যদি জাতীয় সম্পদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে, যেখানে জনগণের খাওয়া-পরা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও অন্য জরুরি বিষয়ের প্রশ্ন জড়িত, সেক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক ধরনের এ বিচারে অপরাধী শাস্তি পেলেও যে জনসাধারণের সম্পদ নিয়ে সে নিজস্ব বিষয়সম্পত্তি করেছে এবং জেল থেকে বের হয়ে তা দিয়ে দিব্যি আরামে বসে বসে জীবন কাটাবে, জনগণ তার সেই হৃত সম্পদের কিছুই পায় না। যেমন ধরা যাক, একজন লোককে এক কোটি বা দুই কোটি টাকার সরকারি বা বেসরকারি খাদ্যশস্য আত্মসাতের অপরাধে কয়েক বছর জেল দেয়া হলো এবং কয়েক লাখ টাকা জরিমানা করা হলো। জরিমানা অনাদায়ে বিচার বিভাগ আরও অতিরিক্ত কয়েক বছর তাকে কারাদণ্ড ভোগ করার শাস্তি দিল। এ অবস্থায় দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি মনে করল যে, ধরা যখন পড়েই গেছি এবং অসম্মানিত হয়েছি, সেক্ষেত্রে জরিমানার টাকা না দিয়ে আরও কয়েক বছর জেলই খেটে যাই, পরে জেল থেকে বের হয়ে তো নিজের আত্মসাত্কৃত বিপুল অর্থের সম্পত্তি ভোগ করতে পারবই। ওই অবস্থায় বিচারের মূল লক্ষ্য আত্মসাত্কৃত সম্পদ তার মূল মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হলো না, বরং সেই সম্পদ অপরাধীর ভোগের জন্য থেকে গেল। ইসলামী আইনের বিধান হলো (বিশেষ করে সরকারি সম্পত্তি হলে) আত্মসাত্কৃত সম্পত্তি বা সম্পদ আত্মসাত্কারীর কবজা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে অর্থাত্ সেটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাজেয়াপ্ত করে প্রথমে রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা দিতে হবে, তারপর ওই অপরাধের জন্য অপরাধীকে শাস্তি দেবে।
অপরাধের প্রকাশ্য শাস্তি
মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজবদ্ধভাবেই তাকে থাকতে হয়। এ অবস্থায় সমাজ সদস্যদের কারোর মধ্যে অপরাধপ্রবণতা থাকলে সমাজের অপরাপর মানুষের অশান্তি ও দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। এ কারণে সব যুগে সব সমাজে অপরাধপ্রবণ লোকদের হাত থেকে সমাজের শান্তিপ্রিয় অপরাপর নাগরিকের জানমাল রক্ষার জন্য যেমন অপরাধ-দণ্ডবিধি চালু রয়েছে, তেমনি অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্যিকার অপরাধী কিনা তা নির্ণয় করার জন্যও বিচার বিভাগ এবং বিচারের রায় কার্যকর করার জন্য থাকে শাসন বিভাগ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অপরাধ আইনে কমবেশি কিছুটা পার্থক্য থাকলেও লক্ষ্য সবারই অভিন্ন অর্থাত্ অপরাধ দমন ও তা নির্মূল করা। কিন্তু এ লক্ষ্য আশানুরূপভাবে প্রায় দেশেই অর্জিত হয় না। ফলে আজ দেশে দেশে কয়েক দিন পরপরই অপরাধ-দণ্ডবিধি পরিবর্তিত হতে দেখা যায়।
পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞ অপরাধ দমন বিশেষজ্ঞ ও আইনবিদের মতে, অপরাধপ্রবণতা দূরীকরণে শাস্তির কঠোরতার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিষয় অপরাধী মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করে। সেটা হলো অপরাধীর সামাজিক সম্ভ্রমে আঘাত হানা। কারণ, একজন অপরাধীকে লোকদৃষ্টির অগোচরে যত কঠোর শাস্তিই দেয়া হোক, বাইরে সেটার খবর প্রকাশে অপরাধী সাময়িকভাবে নিজেকে যতটা না অপমানিত বোধ করে, তার চেয়ে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে তার শাস্তি কিছুটা লঘু হলেও তাতে সামাজিকভাবে তার সম্ভ্রম অধিক নষ্ট হয় বলে প্রকাশ্য শাস্তিকে সে বেশি ভয় করে। প্রকাশ্য শাস্তির দুটি শুভ ফল রয়েছে। একটি অপরাধীর নিজের ক্ষেত্রে, আরেকটি সমাজের ক্ষেত্রে। এ ধরনের শাস্তি অপরাধের পুনরাবৃত্তি থেকে অপরাধীকে বেশি পরিমাণে ফিরিয়ে রাখে আর এ শাস্তি দ্বারা সমাজই বেশি উপকৃত হয়। শাস্তির এ দৃষ্টান্ত সামনে রেখে অপরাধপ্রবণ অনেকেই অপরাধের পথ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে—ওই পরিণতি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য।
এমনিতেই অপরাধ দমন আইনের কার্যকারিতা সম্পর্কে এবং অনেক ক্ষেত্রে এর সঠিক প্রয়োগ না হওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ বিদ্যমান, তার ওপর প্রকাশ্যভাবে সে আইনের অপপ্রয়োগ এবং অন্যভাবে মানুষের অপরাধপ্রবণ হয়ে গড়ে ওঠার উপকরণ জোগানদান ইত্যাদি কারণে সমাজের ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতা আজ মস্তবড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ইসলামী দণ্ডবিধিগুলো খোদ বিজ্ঞানসম্মত এবং সর্বকালের উপযোগী নিরপেক্ষ খোদায়ি বিধান। এ সঙ্গে উল্লিখিত কারণে ইসলাম অপরাধীকে প্রকাশ্যভাবে শাস্তিদানের নির্দেশ দিয়েছে। বলাবাহুল্য, এটাই বিজ্ঞানসম্মত এবং মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে মূল লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, ইসলামী চিন্তাবিদ
Posted ০১:০৯ | মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৩
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin