| বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০১৩ | প্রিন্ট
ঢাকা: ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ সময়ে যেমন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল বঙ্গভবনে ঠিক তেমনি এবারও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন এই চরম সঙ্কট মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি শেষ ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছেন। সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ হলেও চলমান সঙ্কট সমাধানে তিনি তার ‘বিশেষ ক্ষমতা’ বা ‘নৈতিক কর্তৃত্ব’ ব্যবহার করবেন বলে সবাই আশা করছে।
বিদেশি কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীসহ নানাপক্ষের তৎপরতা সত্ত্বেও চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান এখনো অনিশ্চিত। এর মধ্যেই সরকার নিজের মতো করে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে নতুন ছয় মন্ত্রী ও দুই প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া প্রকাশ্য হয়েছে। এ মন্ত্রিসভাকে অনেকেই ‘নির্দলীয়’ বলার চেষ্টা করলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এতে না থাকায় এটিকে ‘বহুদলীয়’ বা ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ বলছেন কেউ। তবে নতুন মন্ত্রিসভার দপ্তর বণ্টন ও ৩৮ মন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়ে এখনো পর্যন্ত ধোঁয়াশা কাটেনি। এ পরিস্থিতির মধ্যে আবার আগামী সপ্তাহেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার চিন্তাভাবনা করছে নির্বাচন কমিশন। যদিও কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে এখনো প্রশ্ন রয়েছে। সবপক্ষের আস্থা অর্জনে তারা এখনো ব্যর্থ। তারপরও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা নিজেদের সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলেই দাবি করছে। গতকাল মঙ্গলবার বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে অবহিতও করেছে কমিশন।
অন্যদিকে টানা কয়েক দফা হরতাল দেয়ার পরও যখন সরকার নিজস্ব সিদ্ধান্তে অটল এবং তা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে তখন বিরোধী দল বিএনপি রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের ২১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। সঙ্কট সমাধানের জন্য তারা রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। সংলাপ শুরুর জন্য রাষ্ট্রপতিকে উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। আর রাষ্ট্রপতিও তার সাংবিধানিক এখতিয়ারের মধ্যে থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করার আশ্বাস দিয়েছেন। সাথে তিনি এও উল্লেখ করেছেন, তার সাংবিধানিক এখতিয়ারের গণ্ডিটা অনেক ছোট। তারপরও তিনি অবশ্যই চেষ্টা করবেন। বিরোধী দলের দাবি দাওয়া ও অভিযোগগুলো সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন।
তবে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা কম হলেও রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে তার নৈতিক কর্তৃত্বের জায়গাটা অনেক বড় বলে মনে করছেন দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। দেশের এরকম সঙ্কট মুহূর্তে এর আগেও রাষ্ট্রপতিরা হস্তক্ষেপ করেছেন। তাই সবার আশা, বিরোধী দল যখন রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হয়েছে তখন তিনি এবার একটা সিদ্ধান্ত দেবেন। আর সবপক্ষের উচিৎ হবে তার সিদ্ধান্তই মেনে নেয়া। এতে একটা সমাধানে পৌঁছানো যাবে বলে সবার আশা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বুধবার বিকেলে বাংলামেইলের সঙ্গে কথপোকথনে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা কম হলেও নৈতিক কর্তৃত্বের জায়গাটা অনেক বড়। এরকম সঙ্কটময় পরিস্থিতে রাষ্ট্রপতিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেহেতু রাষ্ট্রপতি একজন অভিজ্ঞ, জনগণের আস্থাভাজন ও দল নিরপেক্ষ ব্যক্তি এবং বিরোধী দল একরকম ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই রাষ্ট্রপতির কাছে গেছে; তাই সব দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কোনো সিদ্ধান্ত দিলে সবার উচিৎ হবে তা মেনে নেয়া। এক্ষেত্রে উভয় দলকেই তার অবস্থান থেকে কিছুটা ছাড় দিতে হবে।’
বাংলাদেশের ইতিহাসের এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতির উদ্ভব আগেও হয়েছে উল্লেখ করে এ সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ঐক্যমতের ভিত্তিতে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে কোনো সিদ্ধান্ত হলে তা সংবিধানের পরিপন্থি হয় না।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির ওপর নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে না। কিন্তু তার অবস্থান বিশেষ। তার বিশেষ ক্ষমতা আছে। রাষ্ট্রপতি মঙ্গলবার বিরোধী দলের কথা শুনেছেন। আমার মনে হয়, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বিরোধী দলের প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে জানাবেন।’
নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা ও স্বাধীনতা দেয়ার ওপর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে নির্ভর করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসন ও গ্রহণযোগ্য ইলেকশন কমিশন দরকার। যেটার ওপর জনগণ আস্থা রাখতে পারে।’
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির মর্যাদার প্রতিই গুরুত্ব দিলেন। অভিভাবকের সম্মানে তার সিদ্ধান্ত উভয়পক্ষ মেনে নিলে সঙ্কট কাটানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তবে যেহেতু সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খুবই সীমিত করা হয়েছে তাই তিনি এ ব্যাপারে কতটুকু পারবেন সে নিয়ে তার সংশয় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা কম হলেও নৈতিক কর্তৃত্ব রয়েছে। সে কর্তৃত্বের জায়গা থেকে রাষ্ট্রপতি কোনো সিদ্ধান্ত দিলে উভয় দল যদি তা না মানে তাহলে রাষ্ট্রপতির পদটি খেলো হয়ে যায়। এমন আশঙ্কা ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি কতটুকু করতে পারবেন সেটিই এখন দেখার বিষয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘তবে এমন পরিস্থিতে কোনো উদ্যোগ নেয়া আসলেই কঠিন কাজ। তবে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে উভয় দল যদি সহযোগিতা ও কিছুটা ছাড় দিয়ে এগিয়ে আসে তবে অনেক ইতিবাচক সমাধানের সম্ভাবনা রয়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতার মেয়াদ শেষে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় বঙ্গভবন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিল। সাত বছর আবার রাষ্ট্রপতির এ সরকারি বাসভবনেই সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো।
তখনো নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নানা আলোচনা-সংলাপ ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের তীব্র বিরোধিতার মুখে ২০০৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি হন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু সঙ্কট কাটেনি। অবশেষে সেনা হস্তক্ষেপ। ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এরপরই জনগণের দৃষ্টি বঙ্গভবন থেকে সরে যায়।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রহিত করা হয়েছে। সমঝোতার ভিত্তিতে যা কিছু করা তা এখন সংবিধানের বাইরে গিয়েই করতে হবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা তো সঙ্কটের স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। সেটার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা ঠিক করতে না পারলে যে কোনো সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ শেষে এমন সঙ্কট ঘুরে ফিরে আসবে।
Posted ১৪:৩০ | বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০১৩
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin