| সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৪ | প্রিন্ট
ডক্টর তুহিন মালিক
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক বছর পেরিয়ে গেলেও দুর্বল আইনের ফাঁদে আটকে আছে ন্যায়বিচার। বিশ্ব ইতিহাসের তৃতীয় ও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের এই মামলার চার্জশিট আজও দিতে পারল না তদন্তকারী সংস্থা। আর চার্জশিট দিলেইবা কি হবে? যেখানে সমগ্র দেশবাসী এই ঘৃণিত হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি করেছে সেখানে রানার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারায় ‘অবহেলাজনিত দুর্ঘটনার’। যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানই আছে পাঁচ বছরের জেল। হাজারো দরিদ্র নারী শ্রমিকের লাশের সঙ্গে এ যেন পুলিশের এক নির্মম রসিকতা! এত সস্তা জীবন আর এত সস্তায় জীবনের মূল্য পরিশোধ বোধহয় একমাত্র এদেশেই সম্ভব।
এদেশের সাধারণ গরিবের লাশ এখানে ‘দুর্ঘটনা’। এমনকি গণহত্যা হলেও এটা হত্যা নয় বরং নিছক দুর্ঘটনা। এটা শুধু গার্মেন্ট শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই একা নয়। রাস্তায় বাস-ট্রাকের নিচে জীবন হারালেও ৩০২ ধারায় মামলা করা যাবে না বলে এদেশে হুমকি দেয় স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয়। অপরাধ ও শাস্তির ধরনই পাল্টে যাচ্ছে দিনে দিনে। এখন কারও চিরশত্রুকে মেরে ফেলার জন্য গুলি করার প্রয়োজন হবে না। শুধু রাস্তায় গাড়ি চাপা দিয়ে মারতে পারলেই নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। কারণ এটা হত্যা হবে না। এটাকে বলতে হবে ‘দুর্ঘটনা’। কেননা সোহেল রানাদের কপালে আইন প্রণেতাদের চুমুই তাদের ‘ভাগ্য’কে এমনভাবে সুপ্রসন্ন করে দেয়।
এই মামলার দুর্বল এজাহারের বিরুদ্ধে জনদাবির ভয়াবহতা ও জনগণের চাপের মুখে তখন হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেটকেই। তিনি নির্দেশ দিলেন ৩০৪(ক) ধারা নয়, বরং সংযোজন করতে হবে ৩০৪ ধারা। এই ধারায় কাউকে হত্যা না করে মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর সঙ্গে তিনি সংযোজন করলেন মারাত্দক আঘাতজনিত দণ্ডবিধির ৩২৫, ৩২৬ ধারা এবং হত্যাচেষ্টা জনিত ৩০৭ ধারাটি। এতে আইনের প্রয়োগে মারাত্দক সমস্যার সৃষ্টি হলো।
৩০৪ ধারা সংযোজিত হলে অন্য ধারাগুলো তখন আর প্রযোজ্য হবে না। এক্ষেত্রে এই ভুল ধারা সংযোজন করায় পুরো মামলাটাই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনায় পড়েছে। অপরদিকে ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণের দায়ে ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনে অপর একটি মামলা করা হলেও দুই প্রকৌশলীর কাউকেই এই মামলার এজাহারে রাখা হয়নি। এতে করে প্রিন্সিপাল একুইস্ড বা মূল আসামিদের বাদ দিয়ে সহযোগীর বিচারপ্রক্রিয়াটি উচ্চ আদালতে বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। ফলশ্রুতিতে এরই মধ্যে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে যায় সোহেল রানা।
গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর এ মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে রানার বাবা প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তির দুই দিন আগে রানার বাবা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে সভা করেছেন বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।
১১৩৫ শ্রমিকের প্রাণহানি আর কয়েক হাজার শ্রমিকের পঙ্গুত্ব নিয়ে ন্যায়বিচার আজ আইনি শিকলে শৃঙ্খলিত। দিন গড়ালেই তাদের আমরা ভুলে যাই বলেই তাদের বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। তাদের মৃত্যুকে পর্যন্ত আমরা সম্মান দেখাতে পারিনি। তাই তৎকালীন মন্ত্রীদের মুখে শুনতে হয়েছে, ‘সাভার দুর্ঘটনা তেমন ভয়াবহ নয়’ কিংবা ‘রানা প্লাজার ঘটনা তেমন কিছুই নয়’- ধরনের অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তা। ঝাঁকুনি তত্ত্ব বা নড়াচড়া তত্ত্বের কথাটা না হয় বাদই দিলাম।
হত্যাকাণ্ডের বছর পেরিয়ে গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হতাহতের পরিবার আজও পায়নি প্রতিশ্রুতির ক্ষতিপূরণের অর্থ। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা পড়লেও খরচ হয়েছে মাত্র ২২ কোটি টাকা। নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে জীবনের মূল্য পরিশোধের এই নিষ্ঠুরতাকে মেনে নিয়েও শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণের অর্থের দেখা পায়নি। আইন যেন এই গরিব মানুষদের জন্য নয়! কেননা ১৯৬৫ সালের শ্রম আইনে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ছিল ৩০ হাজার টাকা। তখন মজুরি ছিল ১২৫ টাকা। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান ও দ্রব্যমূল্য আড়াইশ গুণ বাড়লেও ২০০৬ সালের শ্রম আইনে এই ক্ষতিপূরণ এক লাখ টাকা করা হয়।
যা গত বছর মন্ত্রিসভার নতুন শ্রম আইনের খসড়া অনুমোদনের সময় দুই লাখ টাকা করা হয়েছে। যদিও ১৮৫৫ সালের মারাত্দক দুর্ঘটনা আইনে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা হিসাব করে ক্ষতিগ্রস্তের গড় আয়ুর দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিধান রয়েছে। এ হিসাবে শ্রমিকপ্রতি অন্তত ৫০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা তাদের। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে এরকম মারাত্মক অপরাধীর সম্পত্তি ক্রোক করে ট্রাস্ট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব। যেখানে মালিকদের পাজেরো-প্রাডো গাড়ির জন্য বীমা করা আছে কোটি টাকার। গাড়িপ্রতি বছরে প্রিমিয়াম দিতে হয় লাখ লাখ টাকার।
অথচ শ্রমিকের জন্য নেই কোনো বীমা সুবিধা। হ্যাঁ আইনে আছে, গোষ্ঠী বীমার আওতায় বাধ্যতামূলক ২০ জন শ্রমিকের বীমা সুবিধা রাখতে হবে। ব্যস এতটুকুই। ২০ জনের জন্য রাখলেই যখন দায়িত্ব সম্পন্ন করা সম্ভব তখন হাজারো শ্রমিকের জন্য কে অযথা খরচ করতে যাবে। গরিবের সন্তান বলেই কি ন্যায়বিচারের নামে এরকম প্রহসন করা হচ্ছে। কেন হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে মামলা করা হলো? এক বছর পেরিয়ে গেলেও কেন মামলার তদন্ত সম্পন্ন হয়নি? কেন ৩০২ ধারায় চার্জশিট করে আদালতে জমা দেওয়া হচ্ছে না। কারণ এ দেশে রানাদের কখনো বিচার হয় না।
২০০৮ সালে রানা প্লাজার অভ্যন্তরে যুবলীগ নেতা গাজী আবদুল্লাহ খুনের আসামি এই রানা। একই বছর সাভার কলেজের ভিপি হেলাল হত্যা ও গুমের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রানার বিশ্বস্ত সহযোগী সাভারের মাদক ব্যবসায়ী মুন্না হত্যার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এমনকি রানার বোনের প্রেমিককে হত্যার অভিযোগ থাকলেও এই মামলাগুলোয় সে রয়েছে বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আমরা দেখেছি এ দেশে অপরাজনীতির ডাল বেয়ে কীভাবে রানারা তড় তড় করে বেয়ে ওঠে। দল, প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে লালন করে রানা নামক এসব বিষবৃক্ষকে। এক খুন করা ছিঁচকে গুণ্ডাকে টেম্পোতে করে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পাঁচ খুনের চরমপন্থিরা আসে পুলিশের ভ্যানে। ৫০ খুনের শীর্ষ সন্ত্রাসী আসে এসি মাইক্রোবাসে। আর হাজারো খুনের রানারা আসে হেলিকপ্টারে চড়ে!
খুনের রেকর্ড যত বাড়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনাও তাদের বেশি থাকে। মাস, বছর পেরুলেও তাদের বিচার হয় না, মামলার তদন্ত আর আগে বাড়ে না। তাই রিমান্ডে রানার হুঁশিয়ারিই বলে দেয় এ দেশে রানারা কখনো রান আউট হয় না। রানাদের যারা বানায় তারা থাকে অন্তরালে, ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর আমরা যত দোষ তার সবটাই খুঁজি রানাদের মুখে। তাই হত্যাকাণ্ড পাল্টে যায় দুর্ঘটনায়। ন্যায়বিচার আইনি ফাঁদে হয়ে যায় বন্দী।
দ্রুতবিচার আইনের মেয়াদ বাড়ালেও তাতে ভয় থাকে না রানাদের। চাঞ্চল্যকর মামলার তালিকায় স্থান পায় না ১১৩৫ প্রাণের হত্যা মামলা। এ ধরনের গণহত্যার পর্যাপ্ত শাস্তির জন্য সংসদে পাস হয় না কোনো ‘গণহত্যা অপরাধ আইন’। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদের বিধান এদের জন্য প্রযোজ্য হয় না। তাই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তিতে আমরা রানাদের রান আউট দেখতে চাই। গোল্ডফিশের মতো একুইরিয়ামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে যেতেই যেন আমরা সব ভুলে না বসি।
লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ।
Posted ১৩:১০ | সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin