| রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৩ | প্রিন্ট
ইসমাঈল সিরাজী, ঢাকা : দেশের রাজনীতি এখন মহা সংকটে। দুই দলের বিপরীত মুখী আচরণ রাজনীতিকে ঠেলে দিয়েছে সংঘাত আর অনিশ্চয়তার পথে। দেশের সুশিল সমাজ, বিদেশী দাতা সংস্থা ও কুটনৈতিক নেতৃবৃন্দও দফায় দফায় বৈঠক এবং আলোচনার ডাক দিলেও কোন সুসংবাদ আসেনি দেশবাসীর কাছে। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিবও পারেননি দুই নেত্রীকে সমঝোতায় আনেতে। এমন অবস্থায় সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে আর দুই নেত্রীকে আলোচনার টেবিলে বসাতে তৃতীয় পক্ষ বা অন্য কোন একটি মাধ্যম খুঁজছে দেশর মানুষ। আর সেই তৃতীয় পক্ষে দুজনের নাম আলোচনায় উঠে এসেছে। দুই দলের আলোচিত ও পরিচিত মুখ তারা। একই সঙ্গে তারা দলের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত। অপরদিকে এই দুজনই আবার এক সময়ের ঘনিষ্ট বান্ধবী। একজন বর্তমান জতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী। অন্য জন তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমান।
জাতীয় সংসদের প্রথম নারী স্পিকার মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান ছাত্র জীবন থেকেই ছিল ঘনিষ্ট বন্ধু।
১৯৮৪ সালে হলিক্রস কলেজে শিরিন শারমীন ও জোবায়দা রহমান একই ক্লাসে পরেছিলেন।তখন থেকেই তারা দুজনেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
এ দুই জনেই দেশের দুই রাজনীতি দলের প্রিয় ব্যক্তি।
দেশের এই ক্লান্তিকালে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ফোন আলাপের পরও সঙ্কট নিরসনে কোন সংলাপ হচ্ছে না, ব্যবসায়ীরাও যখন দুই দলের মহা সচিব পর্যায়ে সংলাপের কথা বলছেন তখন অনেক মানুষই এখন তৃতীয় মাধ্যমে হিসেবে সংলাপে উদ্দেগ নিবে এর আশায় রয়েছেন।
আবার অনেকেই এই দুই বান্ধবি উদ্দ্যেগ নিয়ে সংলাপের প্রতিবেশ সৃষ্টি করার প্রস্তাব করেন ।
সাধারন মানুষ মনে করছে ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী ও ডা. জোবায়দা রহমান দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপের উদ্দ্যেগ নিতে পারে।
কারণ ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ট ও পছন্দের। অপর দিকে ডা. জোবায়দা রহমান বিরোধী দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রিয়।
১১/১ এর যার ভূমিকায় খালেদা জিয়া মুগ্ধ হয়েছেন।
শিরিন শারমীন চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী : ১৯৬৬ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী। তাঁর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে তাঁর সচিব ছিলেন। মা প্রয়াত নাইয়ার সুলতানা পেশায় অধ্যাপক ছিলেন। স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক হোসাইন ওষুধ বিশেষজ্ঞ। তিনি দুই সন্তানের জননী। তার পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলায়।
শিক্ষা জীবনের প্রতিটি পর্বে গৌরবময় সাফল্যের অধিকারী ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এর আগে স্নাতকেও (সম্মান) তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক শাখায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম এবং ১৯৮৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় একই শাখায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। তিনি যুক্তরাজ্যের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাইট অব ল বিষয়ে গবেষণায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি আইন পেশায় মানবাধিকার ও সংবিধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে আইন পেশায় নিয়োজিত থাকেন। ঐতিহাসিক মাজদার হোসেন মামলার তিনি অন্যতম আইনজীবী ছিলেন। তিনি সংরক্ষিত মহিলা কোটায় বর্তমান সংসদে সংসদ সদস্য হন। পরে তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হন।
জোবায়দা রহমান সংক্ষিপ্ত জীবনী : জোবায়দা রহমান জিয়া পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ। তারেক রহমানের স্ত্রী। পেশায় চিকিৎসক। তার বাবা নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান রিয়ার এডমিরাল (অব.) প্রয়াত মাহবুব আলী খান। যোগাযোগ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে সিলেট বিভাগে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য মাহবুব আলী খানেরও রয়েছে আলাদা ইমেজ।
বাড়ির ছোট মেয়ে ডা. জোবায়দা দেশের রাজনীতিতে পরিচিত মুখ না হলেও ওয়ান ইলেভেনের প্রেক্ষাপটে তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকো ও বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে এই পরিবারের দেখভাল করতে গিয়ে প্রকাশ্যে আসেন তিনি। স্বল্পভাষী এ নারী সে সময় সবার নজর কাড়েন। চিকিৎসার জন্য তারেক রহমান লন্ডনে গেলে পরবর্তী সময়ে তিনিও সেখানে যান। বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আদৌ কোনো সমঝোতার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর মধ্যে কোনো সংলাপ আদৌ হবে কিনা, তা এখনো অনিশ্চিত হলেও একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার দিকেই সরকার এগিয়ে যাচ্ছে।
বিরোধী দল বলছে, সংকট নিরসনে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে এবং দাবি আদায়ে আগামীতে আরও কর্মসূচি ঘোষণার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ।
সরকার বলছে সমাধান হতে হবে সংবিধানের মধ্যে থেকেই।
২৫শে অক্টোবর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ থেকে দুইদিনের আলটিমেটাম ঘোষণা করেন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া।
এরপর ২৬শে অক্টোবর সন্ধ্যায় বিরোধী নেতার কাছে মোবাইলে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগেই দিনভর বিরোধী নেতা প্রধানমন্ত্রীর ফোন ধরছেন না বলে সংবাদ প্রচার হয় গণমাধ্যমে।
আলাপের শুরুতেই দুই নেত্রী বাহাসে জড়িয়ে পড়েন লাল টেলিফোন ইস্যুতে। বাস্তবে দেখা যায়, দীর্ঘদিন থেকেই অচল পড়েছিল বিরোধী নেতার সে লাল টেলিফোন। দীর্ঘ ৩৭ মিনিটের আলাপে অতীতের অনেক অপ্রিয় বিষয় উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর তরফে। বিরোধী নেতা বারবার অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবার তাগিদ দিলেও আলাপ মধুর হয়নি।
একপর্যায়ে নির্বাচনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী পরদিন বিরোধী নেতাকে গণভবনে রাতের খাবারের দাওয়াত দেন। হরতাল কর্মসুচির কারণে বিরোধী নেতা ২৮শে অক্টোবর অপারগতা প্রকাশ করে ২৯শে অক্টোবর রাতের পর থেকে যে কোনদিন দাওয়াতে রাজী হন। কিন্তু পরে সরকারের তরফে সে দাওয়াতের ফলোআপ করা হয়নি।
সর্বশেষ শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা দুইদলের মহাসচিব পর্যায়ে একটি সংলাপের প্রস্তাব নিয়ে দুই শীর্ষ নেত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া ব্যবসায়ী নেতাদের প্রস্তাব স্বাগত জানালেও তা সরাসরি নাকচ করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উল্টো বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরামের চার নেতাসহ শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যবসায়ী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চারদিন কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয় বিরোধী নেতার বাসভবন। বিরোধী জোটকে এড়িয়ে ইতিমধ্যে নির্বাচনী মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে সরকারী দল আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন, গণতন্ত্র ও ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের সাধারন জনগন থেকে রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিক সকল মহল।
এদিকে আগামীকাল শুক্রবার সকালে সংলাপের ব্যাপারে আলোচনার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে বারবার ফোন করলেও তিনি ধরছেন না বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, চলমান সঙ্কট নিরসনে সরকার সংলাপের যে কথা বলছেন তা সঠিক নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, বিরোধীদলের তরফে বারবার চেষ্টার পরও সরকার উদ্যোগী হচ্ছে না। বিগত কয়েকদিন ধরে আমি ব্যক্তিগতভাবে সৈয়দ আশরাফ সাহেবকে বারবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরছেন না। মির্জা আলমগীর বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বিগত জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর বাসভবনে একটি বৈঠকের কথা ছিল। আমি সেখানে উপস্থিত হলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বৈঠকে অংশ নেননি। তিনি বলেন, ২৬শে অক্টোবর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোবাইল ফোনে বিরোধী নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। তবে হরতাল কর্মসুচির কারণে পরদিন প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াত রক্ষা করতে পারেননি বিরোধী নেতা। কিন্তু ৩০শে অক্টোবরের পর বিরোধী নেতা যে কোনদিন রাজী হওয়ার পরও সরকারের তরফে কোন উদ্যোগ আর নেয়া হয়নি।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুলের কোন ফোন পেয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে সৈয়দ আশরাফ বলেন, আজ ফখরুলের কোন ফোন পাইনি। সংলাপের বিষয়ে আমি আগেও তাঁকে ফোন দিয়েছি, তিনিও আমাকে ফোন দিয়েছেন। আমরা সব সময় আলোচনা করতে চাই। তিনি যদি এখনই ফোন করেন আমি ওনার ফোন ধরবো। তবে আমার সঠিক নাম্বারে ফোন করতে হবে। আলোচনার জন্য যদি ওনি প্রস্তাব দিয়ে থাকেন, এ ব্যাপারে ওনার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সময় আমরা নির্ধারণ করবো।
এদিকে সঙ্কট নিরসনে ব্যাপক কূটনৈতিক তত্পরতা লক্ষ কড়া গেছে।
সঙ্কট সমাধানে দুই নেতার প্রস্তাব দেয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে প্রধান দুই দলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ও অস্ট্রেলিয়া।
Posted ০২:৪৮ | রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৩
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin