রবিবার ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রমযান : আত্মরক্ষা ও জীবন গঠনের মাস

  |   সোমবার, ২৯ জুলাই ২০১৩ | প্রিন্ট

রমযান : আত্মরক্ষা ও জীবন গঠনের মাস
আবদুল কাদির সালেহ 
অফুরন্ত  রহমত ও বরকতে পরিপূর্ণ মাহে রমযান। এর একেকটি আমল ও আহকামের তাৎপর্য এত বিশাল তা সত্যিই বর্ণনার চেয়েও বাড়ন্ত। একের ভিতরে বহুর মতো। মানব জীবনে  রোযার সাধনার এতো বহুমাত্রিক আবেদন রয়েছে- যা সত্যিই যেকোন চক্ষুষ্মানকে মুগ্ধ না করে পারে না। রাসূলে করীম (সা:) ও এই মাসকে বলেছেন ‘ শাহরুন আজীম’ ও ‘ শাহরুন মুবারাকুন’ অর্থাৎ মহাপবিত্র ও বরকতময় মাস। আমরা যদি আমাদের সনাতন চিন্তাকে ঝেরে ফেলে দিয়ে একটু গভীব মনোনিবেশ সহকারে চিন্তা করি তাহলে রমযানের মাহাত্ম্য এবং  কার্যকারিতার পরিধির ব্যাপকতা আমাদের সামনে সু¯প®ট হয়ে উঠবে। আমরা দেখতে পাবো, কি বিপুল বর্ণঢ্যভাবে রমযান আমাদের জীবনকে রাঙ্গাতে চায়, কি মহান ঐশ্বর্যময়তায় চায় আমাদের জীবনকে গড়ে তুলতে। আমাদের জীবনের যে মহান লক্ষ্য আল্লাহকে পাওয়া, এ কার্যে মরদূদ শয়তান নানা রূপ ও কৌশলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মানুষকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত করতে চায়।
          আল্লাহকে পাওয়ার পথ নির্বিঘ নয়। প্রতিরোধের বেড়ী, প্রতিবন্ধকতার বিষাক্ত কাঁটা মানুষকে তার জীবনের মহৎ লক্ষ্য পানে চলার পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলে। রমযান এক্ষেত্রে ঢাল বা বর্ম হিসাবে কাজ করে। রাসূল করীম ( সা:) বলেছেন, ‘ আসসাওমু জুন্নাতুন- রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ’ একজন রোযাদার রোযার ঢালে সজ্জিত হয়ে নিজের জীবন ও কর্র্মকে বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির খপ্পর থেকে রক্ষা করতে পারে। অন্যায়, অনাচার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ফালতু-ফাজলামী-বেহুদা কার্যকলাপ ও সকল প্রকাল অশ্লীলতার আগ্রাসন থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।
চিন্তা করলেই দেখা যাবে, মানুয়ের আভ্যন্তরীণ যতো দূর্বলতা, ক্রটি বিচ্যুতি ও অবক্ষয় দেখা দেয়- এর মূলে রয়েছে অপরিমিত পানাহার এবং অনিয়ন্ত্রিত যৌন জীবন। উপরোক্ত কারণে অনেকের জীবনে ধ্বংস এবং অনিবার্য বিপর্যয় নেমে আসে। এর নজীর তো আমরা আমাদের চারপাশে বরাবরই দেখতে পাই। অতিভোজন শারীরিক সকল প্রকার রোগ-ব্যাধির জনক এবং অদম্য লিপ্সার উদগাতা। ভোজনব্যাধি আজ রীতিমতো সামাজিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে। জীবনঘাতী ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগতো অপরিমিত ভোজন থেকেই সৃষ্ট। বলা বাহুল্য এ রোগ একবার কাউকে পেয়ে বসলে তার জীবনের সকল ইচ্ছা এবং রসনা তৃপ্তির পথে অবধারিত প্রাচীর দাঁড় করায় এবং বলা যায়, জীবনকে নিরামিশে পরিণত করে। ডায়াবেটিস যার হয়েছে তার জীবনে কি আর কোন ছন্দ থাকে ? এটা খাওয়া যাবে না, ওটা ছোঁয়া যাবে না, মিষ্ঠি খাওয়া যাবে না, গোশত খাওয়া যাবেনা, চিনি খাওয়া যাবেনা, চকোলেট খাওয়া যাবে না, ছটাকের বেশি ভাত খাওয়া যাবে না- এমনকি আরো অসংখ্য ‘না’ -এর দেয়াল খাঁড়া করে জীবনকে এক গেড়াকলে বন্ধী করা হয়। রোযা অতিভোজন বন্ধ করে, খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকতা  ও পরিমিতিবোধ নিয়ে আসে। নিজের ইচ্ছা এবং রসনার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার শক্তি যোগায়।
পানাসক্তির ক্ষেত্রেও একই  কথা প্রযোজ্য। পানাভ্যাস  এমন এক নেশা যার অক্টোপাসের মতো বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। মদ, গাঁজা, হিরোইন প্রভূতির নেশা যাদেরকে একবার পেয়েছে তাদের আর রক্ষা আছে কি ? এজন্য  অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এখন স্যাটায়ার করে শ্লোগান বের করেছে- ‘ নেশা খাবি খা/ মারা যাবি যা।’এর কবল  থেকে রক্ষার জন্য, জনমত গঠন ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এখন অনেক সামাজিক ও দাতব্য সেবামূলক সংস্থা-সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সরকারী পৃষ্টপোষকতায়ও অনেক প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে; কিন্তু বিনিময়ে ফলাফল বলতে হবে শূন্যের কোঠায়। মদ খেয়েখেয়ে বুঁদ মাতাল হয়ে মরে যাবার ঘটনা অসংখ্য। কিন্তুু তবুও এ পথ থেকে ফিরে আসছে না বিভ্রান্ত প্রজন্ম। আসছে না মানে আসতে পারছেনা। একবার কেউ নেশাসক্ত হয়ে পড়লে এ থেকে আর ফিরে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, আসক্তি একবার পেয়ে বসলে মানুষ তখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সে হয়ে যায় নেশার বশ, নফসের দাস। সে ইচ্ছা করে নেশা করে না, নেশা তাকে বাধ্য করে। অর্থাৎ নেশা না করলে তার জীবন হয়ে উঠবে দূর্বিষহ। রোযা মানুষকে পানাসক্তি নিয়ন্ত্রয়নের হাতিয়ার তার হাতে তুলে দেয়। এছাড়াও সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে সিগারেট, পান এবং চায়ের অভ্যাস দেখা যায়। কেউ কেউ তো এ সবের দ্বারা এতোটা আসক্ত থাকে যে, সিগারেট একটার পর আরেকটা না ধরালে তার শরীর মনে যেনো কোন কর্মোদ্যোগই সৃষ্টি হয় না। কেউ আছেন ভাত না খেলে চলে তো  পান না খেলে চলে না। একইভাব চলে চা-কফির অভ্যাসও।  অর্থাৎ মানুষ তার অভ্যাসের দাসে পরিণত হয়ে যায়। যারা এধরনের অভ্যাসের নেশায় নিজের জীবনকে অপাংতেয় করে তুলেছে রোযা তাদের জন্য সত্যি সত্যিই আত্মরক্ষার ঢালস্বরূপ।
             মানুয়ের জৈবিকতার আরেকরূপ হচ্ছে কাম প্রবৃত্তি। এটা মানুষের জৈবিক সত্তার স্বাভাবিক অনুষংগ হলেও  একে যদি বলগাহীনভাবে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে তা ধাবমান উন্মত্ত পাগলা ঘোড়ার মতো শোভন সকল বৃত্তি ও বাঁধনকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। জীবনের ছন্দোময় গতি ও শৃংখলাকে করে দেয় লন্ডভন্ড।  সকল সংযম এবং মাত্রাবোধের বেড়ী ডিঙ্গিয়ে মানুষকে পরিণত করে উন্মাত্ত এক দৃশ্যমান শয়তানে। বলা বাহুল্য, এই ভোগোন্মত্ততা মানুষের জীবনের নিয়ে আসে নৈরাজ্য ও উচ্ছৃংখলতা। এ ব্যাধি দ্বারা যদি একবার কেউ আক্রান্ত হয়, তাহলে তার আর রক্ষে নেই। বর্তমান যুগকে বলা হয় – আধুনিকতার যুগ। কেউ কেউ আধুনিকতার অর্থ করেন মানবাধিকার ও স্বাধীনতার  যথার্থ মূল্যবোধের সাম্প্রতিক শোভন প্রবণতাকে। এই প্রেক্ষিতে আমরা যদি আমাদের সামাজিক পরিবেশের দিকে তাকাই, তাহলে কি মানবাধিকার ও স্বাধীনতার মূল্যবোধের প্রতি সাধারণভাবে মানুষকে শ্রদ্ধাশীল  দেখতে পাওয়া যায় ? বিশেষ করে যে বিষয়টি মানবতার সকল ঐশ্বর্যকে মসিলিপ্ত করে রেখেছে, তা হচ্ছে ঘৃণ্য পতিতাবৃত্তি। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে পতিতাবৃত্তি নেই। পুরাদন্তুুর সরকারী লাইসেন্স ও অনুমোদন নিয়ে চলছে দেশে দেশে পতিতাবৃত্তি। এটা শুধু সমাজকে কলুষিতই করে না, সভ্যতার জীবনীশক্তিকেও নিঃশেষ করে দেয়। যদি প্রশ্ন করা হয় কারা পতিতালয়ে যায়, কেন যায়, আর কেনইবা এই ব্যবসা উত্তরোত্তর সংগঠিত ও সম্প্রসারিত হচ্ছে। অন্তত: সভ্য সমাজে তো তা হবার কথা না। জবাব সহজ। এর মূল কারণ অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে মানুষের নিয়ন্ত্রণহীন বিকৃত যৌন জীবন। অনেক স¤পন্ন ঘরের পুরুষদেরকে দেখা যায় ঘরে সুন্দরী স্ত্রী রেখে পতিতাগমন করতে। আবার বাহ্যত অনেক সুভদ্রা মহিলাকেও দেখা যায়, ঘরে সামর্থবান স্বামী, সন্তান রেখেও বহুগামী হতে। এটা হয় এ জন্য যে, যৌন জীবনে তারা নিয়ন্ত্রণহীন। তাদের জীবনের সকল চাহিদাকে ছাপিয়ে  এই লোলুপ স্বভাবটাই চড়ে বসেছে তার কাধে। ফলে দেখা যায়, তারা পরিবার, সমাজ ও সভ্যতার সকল ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যকে পদদলিত করে দিয়ে এই পঙ্কিল আর্বতে পা বাড়ায়। এর পরিণতি যে কত করুন, ভয়াবহ ও বিভৎস তা আমরা যদি পাশ্চাত্য সমাজের দিকে তাকাই তাহলেই সু¯পষ্ট হয়ে উঠবে। কিছু লোক আছে যারা এই ল¤পট্যের পক্ষে উকালতি করতে গিয়ে বলে থাকে আমাদের সমাজে বিনোদনের সহজ ও পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকার কারণে মানুষ বিকৃত বিনোদনের পথ খোঁজে। এখান খেকেই নাকি পতিতাবৃত্তির জন্ম। এজন্যই এই ব্যবসা, ঘৃণ্য হলেও সমাজে টিকে আছে। উত্তরোত্তর স্ফীত হচ্ছে । আসলে তাদের এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে কোন সারবত্তা নেই। এরা যে নিজেদের স্বভাবের কদর্যতাকে বৈধতা দানের জন্যই এই ধরনের খোঁড়া ও ভিত্তিহীন যুক্তি খাড়া করে থাকে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
          আমরা আমাদের সন্দেহ নিরসনের জন্য পশ্চিমা সমাজ থেকেই এর উদাহারণ নিতে পারি। পশ্চিমা সমাজ তো এখন অবক্ষয়ের অতলান্তে গিয়ে উপনীত হয়েছে। ভিন্ন অর্থে কেউ যদি পশ্চিমা সভ্যতাকে এখন ল¤পট সভ্যতা নামে আখ্যায়িত করে তাহলে খুব একটা অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয়না। পশ্চিমা সমাজে বিনোদনের কোন অভাব নেই। পার্ক, উদ্যান, সৈকত, প্রেমকানন বা বিনোদনস্কোয়ারের কোন ঘাটতি নেই। তবুও তো সেখানে নারী ধর্ষণ, অপহরন, যৌন নিপীড়ন এশিয়া, আফ্রিকার চেয়ে বেশী। তবে কেন বেশী ? এর কারণ তাদের বলগাহীন যৌন জীবন।  ফলে সেসব দেশে সেক্স উপকরনের শিল্গ আজ শনৈ শনৈ করে উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে। সভ্যতার এর চেয়ে বড়ো অন্ধকার আর কি হতে পারে ? মানবতার জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কিছু আছে কি?
          মোটকথা নিয়ন্ত্রণহীন পানাহার এবং কামাচার ব্যক্তি, সমাজ দেশ ও সভ্যতার জন্য অভিশাপ। এটা হয়তো অনেকেই বুঝে থাকে কিন্তুু একবার ঐ পথে প্রবিষ্ঠ হবার পর এ থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ আর থাকেনা। সাপ যখন কোন কিছু তার মুখগহ্বরে প্রবিষ্ঠ করে নেয় – তখন তা আর উগলে দিতে পারে না; তেমনি প্রাণী বিজ্ঞানীদের মতে, সাপের দাঁেতর ভেতরের ভাঁজ থাকে উল্টো দিকে, তাই কোন কিছু মুখে নিয়ে নিলে গলায় অবশেষে আটকে গেলেও তা আর বের করে দিতে পারে না। মানুষের বদভ্যাসের অভিশাপও তেমনি। রমযান এজন্যই ঢাল হিসাবে একজন রোযাদারকে এসব কু-অভ্যাসের  দাসত্ব শৃংখল থেকে রক্ষা করে। রাসূল করীম ( সা:) যথার্থ শব্দেই রমযানের বৈশিষ্ট্যকে  আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। রোযা তাই আমাদের ব্যক্তি জীবন, সমাজজীবন এমনকি সভ্যতা সংস্কৃতিকে সুরক্ষার জন্যও অতি উত্তম হাতিয়ার।
রমযানের সিয়াম সাধনা আখেরাতের মুক্তির পথই শুধু দেখায় না, সমাজ মুক্তিরও দিগদর্শন বটে।
লেখক পরিচিতি :
অধ্যাপক মাওলানা আবদুল কাদির সালেহ
সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও রাজনীতিবিদ
সাবেক সহকারী সম্পাদক
দৈনিক আল মুজাদ্দেদ
Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৪:২৯ | সোমবার, ২৯ জুলাই ২০১৩

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com