| শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৩ | প্রিন্ট
মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী
‘মুফতী ফজলুল হক আমিনী’ শুধু একটি নামই নয়,একটি আন্দোলন, ইতিহাসের এক বিশাল পাঠ! তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধেএক প্রচন্ড অগ্নীগিরী। তিনি ছিলেন মজলুমানের একবিপ্লবী কন্ঠ। দেশপ্রেমিক ঈমানদার তৌহিদী জনতার কল্যাণকামী এক মহান নেতা। জেল জুলুম উপেক্ষাকরে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে জালেম শাহীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বাতিলের সামনে দ্বীনে ইসলামের আওয়াজকে যিনি উচ্চকিত করতেন, ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জাতির র্দুদিনে যিনি হুংকার দিয়ে গর্জে উঠতেন, সমস্যাসমাধানে শরীয়া ভিত্তিক সমাধান- ফতোয়া দিয়ে আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দিতেন সেই বিপ্লবী নেতা আমাদের মাঝে আজ নেই। ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী নেতা মাওলানা ফজলে হক খয়রাবাদির ন্যায় যিনি কাফনের কাপড় সাথে নিয়ে আজীবন সংগ্রামকরে জীবনের শেষ সময়টুকু ইসলাম বিদ্বেষী তাগুতি শাসকগোষ্টির সকল অপকর্মের দাতঁভাঙ্গা জবাব দিতে গিয়ে র্দীঘ দিন গৃহবন্দিত্ব বরণ করেন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন, বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন জননেতা, বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ,ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমীর মুফতি ফজলুল হক আমিনী বিগত ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ঈসায়ী মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২ টা ২০ মিনিটের দিকে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে স্ত্রী ২ ছেলে ৪ মেয়ে ও নাতী নাতনী সহ অসংখ্য ছাত্র রেখে গেছেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে স্ট্রোক করলে তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তিনি শেষ নি:শাষ ত্যাগ করেন। মধ্যরাতে দৈনিক ইনকিলাবের সিলেট অফিসের সাংবাদিক ফয়সাল আমীন ভাই ‘মুফতি আমিনী সাব আর নেই’ যখন এই সংবাদটি দিলেন তখন নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারলামনা। হঠাৎ থেমে গেছে বজ্রনির্ঘোষের এক মহান প্রতীকমানবের বর্ণাঢ্য জীবন। বুধবার বিকাল ৩টা ২৫ মিনিটে জাতীয় ঈদগাহে তার নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে তাকে লালবাগ মাদরাসার শাহী মসজিদ গোরস্থানে দাফন করা হয়। জানাযা পূর্ব সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, মুফতী আমিনীকে তিলে তিলে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে বিদায় করার ঘোষণাও দেয়া হয় সেখানে। জাতীয় ঈদগাহে মুসুল্লীদের ঢল নামতে থাকে। জাতীয় ঈদগাহ, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণসহ আশেপাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুফতী আমিনীর জানাযায় অংশগ্রহণ করেন লাখো মুসুল্লী। জানাযার সময় চোখের পানি ফেলে তার মাগফিরাত কামনা করা হয়। জানাযা পূর্ব সমাবেশে বক্তব্যের সময় মুফতী আমিনীকে গৃহবন্দী করে রাখায় সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুসুল্লীরা। জানাযা নামাজে ইমামতি করেন লালবাগ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস, মুফতী আমিনীর দীর্ঘকালীন সহপাঠী ও সহকর্মী হযরত মাওলানা আব্দুল হাই।
মরহুম আমিনী (র.)র ইন্তেকালের মাত্র ক‘দিন পুর্বে লালবাগস্থ তার কার্যালয়ে স্বাক্ষাত করে আসলাম, ইংল্যন্ড প্রবাসী হাফিজ মাওলানা সৈয়দ জুনাইদ আহমদ তাকেঁ কয়েকটি গ্রন্থ উপহার দিলেন, আমি দিলাম ‘আস সিরাজ’ এর একটি সংখ্যা। সেদিন আমার এক প্রশ্নের জবাবে বাংলার এই সিংহপুরুষ বলেছিলেন, আমার উপর যুলুম নির্যাতন যতই আসুক, আমি সত্য বলেই যাবো, দেশ বাসীর প্রতি আমার আহবান যেকোন মুল্যে ইসলাম বিদ্বেষী এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে।’ মানচেষ্টার জমিয়ত নেতা হাফিজ মাওলানা সৈয়দ জুনাইদ আহমদ, মুফতি ফয়জুল্লাহ ও হাফিজ সৈয়দ সোহাইল আহমদ এসময় উপস্থিত ছিলেন। জানিনা জাতির এই দু:সময়ে বাতিলের বিরোদ্ধে বজ্রহুংকার কে দেবেন?
মুফতি আমিনী এদেশে ইসলামী আন্দোলন ও সংগ্রামে অতি পরিচিত মুখ। সাবেক চারদলীয় এবং বর্তমান ১৮ দলীয় জোটের তিনি ছিলেন শীর্ষ নেতা। মুফতি আমিনী লালবাগ জামেয়া কোরআনিয়া এবং বড় কাটারা আশরাফুল উলুম মাদরাসা ছাড়াও অসংখ্য দীনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদীদের এই উৎপাতকালে এক আমিনীর খুবই প্রয়োজন ছিলো। আওয়ামী সরকারের ইসলামবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মুফতি আমিনী সরকারের রোষানলে পড়েন এবং প্রায় ২ বছর ধরে তাকে ঢাকার লালবাগ মাদরাসা ক্যাম্পাসে একরকম বন্দি করে রাখে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একাধিকবার মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়। ইসলামের পক্ষে সাহসী ভূমিকা রাখায় তার ছেলেকেও গুম করাহয়েছিল। এর আগে আওয়ামীলীগের ৯৬-২০০১ সালের ক্ষমতার সময় ‘ফতোয়ার বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি দীর্ঘ দিন কারা ভোগ করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী : ১৯৪৫ সনের ১৫ই নবেম্বর বি-বাড়ীয়া জেলার আমীনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে মুফতী ফজলুল হক আমিনীর জন্ম। পিতা: আলহাজ্জ মরহুম ওয়ায়েজ উদ্দীন, মাতা: মোছাঃ ফুলবানু নেছা। বি-বাড়ীয়া জামেয়া ইউনুসিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মুফতী আমিনী মুন্সিগঞ্জ জেলাধীন বিক্রমপুরের মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসায় তিন বৎসর পড়াশুনা করেন। তারপর উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৬১ সনে রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসায় চলে আসেন। এখানে তিনি হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহঃ) ও হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) সহ অভিজ্ঞ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদীসের সনদ লাভ করেন। ১৯৬৯ ইংরেজি সনে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী [রহঃ]-এর কাছে হাদীস ও ফেকাহ্ তথা ইসলামী আইনের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান করাচী নিউ টাউন মাদরাসায় গমন করেন। সেখানে তিনি উলুমুল হাদীস ও ইসলামী আইনের ওপর বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সনে। প্রথমে মাদরাসা-ই-নূরিয়া কামরাঙ্গীরচরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই তিনি হযরত হাফেজ্জী হুযুর [রহঃ]-এর কন্যার সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭২ সনে মাত্র নয় মাসে তিনি সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ হেফয করেন। এ সময় তিনি ঢাকার আলু বাজারে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে আলু বাজার মসজিদের খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৫ সনে তিনি জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসার শিক্ষক ও সহকারী মুফতী নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সনে তিনি লালবাগ জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রধান মুফতীর দয়িত্ব পান। ১৯৮৭ সনে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ)-এর ইন্তিকালের পর থেকে তিনি লালবাগ জামেয়ার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সনে বড়কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব পান। ইন্তিকালের আগ পর্যন্তই এই দুইটি মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পাশাপাশি ঢাকার কাকরাইল, দাউদকান্দির গৌরীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু মাদরাসার প্রধান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে তার ভূমিকা : ইসলামী আইন ও আদর্শের বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল মুফতী আমিনীর সরব পদচারণা। দুই যুগ ধরে আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল সরব ও সোচ্চার কণ্ঠ হিসাবে তাকে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮১ সালে খেলাফত আন্দোলন গঠিত হলে তিনি মনোনীত হন এ সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ)-এর ইন্তিকালের পর তিনি দেশে অধিকাংশ ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে পুরুষের ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। ১৯৯২ সনে বাবরী মসজিদ লংমার্চসহ, ১৯৯৪ সনে নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। বর্তমানে তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমীর, উলামা কমিটি বাংলাদেশের উপদেষ্টা ও খেলাফতে ইসলামী বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। তিনি ছিলেন আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা চারদলীয় জোটের অন্যতম প্রধান রূপকার ও শীর্ষ নেতা। ২০০১ সনে হাইকোর্ট থেকে ‘সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ’ সংক্রান্ত কোরআন-হাদীস বিরোধী রায় ঘোষিত হবার পর তিনি প্রথম গর্জে উঠেছিলেন। রায় প্রদানকারী দুই বিচারপতিকে শরীয়তের আলোকে তিনি মুরতাদ ঘোষণা করেছিলেন। আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তিনি আওয়ামী দুঃশাসনের কোপানলে পড়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দীর্ঘ চার মাস তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ২০০১ সনে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি চারদলীয় ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বি, বাড়ীয়া-২ (সরাইল ও সদরের আংশিক) নির্বাচনী আসন থেকে প্রতিদ্বনিদ্বতা করে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বেশ কয়েকবার হজ্জ-ওমরা পালনসহ তিনি লন্ডন, সিরিয়া, ভারত, কুয়েত ও পাকিস্তান সফর করেছেন। ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বন্ধে ১৯৮৪ ইং সনে তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুরের শান্তি মিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মুফতী আমিনী ছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ)-এর ‘মুজাযে সুহবত’। পরবর্তী সময়ে তাকে হযরত হাফেজ্জী হুযুর (রহঃ)-এর অন্যতম খলীফা হযরত মাওলানা আব্দুল কবীর (রহ.) সহ হযরত হাফেজ্জী হুজুর [রহঃ]-এর আরও কয়েকজন বিশিষ্ট খলীফা বাইয়াত করার অনুমতি প্রদান করেন। বাংলা, আরবী ও উর্দ্দু ভাষায় তিনি ১৫ টি গ্রন্থের লেখক ছিলেন। পরিশেষে ইতিহাসের এই ক্ষণজন্মা পুরুষের প্রশান্ত আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক: সভাপতি- পুষ্পকলি সাহিত্য সংঘ, সিলেট।
Posted ১৫:০৪ | শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৩
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin