| বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০১৪ | প্রিন্ট
শফিক রেহমান
সোমবার ১০ মার্চ ২০১৪-তে বিশ্ববাসী জানতে পারে শনিবার ৮ মার্চ মধ্যরাতে কুয়ালালামপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ (MH-370) পরদিন নির্ধারিত সময়ে বেইজিংয়ে পৌঁছায়নি। বেইজিং এয়ারপোর্টে ফ্লাইট এরাইভাল নোটিশ বোর্ডে এমএইচ-৩৭০-এর পাশে লেখা ওঠে, DELAYED (ডিলেইড বা বিলম্বিত)। কিন্তু ধীরে ধীরে জানা যায় প্লেনটি বিলম্বিত হয়নি, হয়েছিল VANISHED (ভ্যানিশড বা অদৃশ্য)।
এরপর ১০ মার্চ থেকে ২৭ মার্চে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিশ্ববাসীর চোখ নিবদ্ধ থাকে পত্রিকার পাতায়, টিভির নিউজে এবং কমপিউটার স্কৃনে অনলাইন খবরে। গভীর কৌতূহলের সঙ্গে মানুষ অনুসরণ করেছে এমএইচ-৩৭০ সম্পর্কিত প্রতিটি সংবাদ-মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষের বিবৃতি, মালয়েশিয়ান ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রীর বিবৃতি, মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি এবং ২৬টি দেশের যৌথ প্রচেষ্টায় নিখোঁজ প্লেনটিকে খোঁজা। সবার মনেই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল এই হাইটেকের যুগে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে এত বড় একটা প্লেন ভ্যানিশ করে গেল? কিভাবে আকাশে বিলীন হয়ে গেল? এমএইচ-৩৭০ বিষয়ে আমি কৌতূহলী থেকেছি বিশেষ কয়েকটি কারণে।
প্রথমত আমি প্লেনে ট্রাভেল বিষয়ে আগ্রহী ছোটবেলা থেকে। প্রথম উড়ন্ত প্লেন দেখি ১৯৪৪-৪৫-এ কলকাতায়, পার্ক সার্কাসে। তখন ঝাঁকে ঝাঁকে জাপানিজ ফাইটার প্লেন দুপুর এবং বিকালে আসত কলকাতায় খিদিরপুর ডকে বোমা ফেলতে। সূর্যের আলোতে ফর্মেশন ফ্লাইটে জাপানিজ প্লেনগুলো আকাশে চিকচিক করত। প্লেনে প্রথম ফ্লাই করি এর প্রায় ১০ বছর পর। আগস্ট ১৯৪৭-এ ইনডিয়া পার্টিশনের পরে আমরা চলে আসি ঢাকায়, পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৫৪-তে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলাম মেমরি টৃপে। সেখান থেকে ইনডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি ডাকোটা প্লেনে ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম।
এরপর আমার অগ্রজপ্রতিম পাইলট বন্ধু ওয়ারেস আলির কল্যাণে বেশ কয়েক ঘণ্টা ছোট প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়। ওয়ারেস আলি ছিলেন ফ্লাইং ইন্সট্রাকটর। তার ছাত্র না থাকলে মাঝে মাঝে তিনি আমাকে প্লেনে নিতেন এবং আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা ফ্লাই করতাম। দিনে এবং সন্ধ্যায়। এসব প্লেন ছিল টাইগার মথ এবং চিপ মাংক। এ ধরনের ছোট প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা অন্য রকম এবং বলা যায় এক ধরনের নেশা সৃষ্টিকারী। ককপিট থেকে ইচ্ছা অনুযায়ী প্লেনে উপর-নিচে ওঠানামা, ইচ্ছা অনুযায়ী দিক পরিবর্তন করা, লো ফ্লাই করে মাটিতে নিজের বাড়ি এবং অন্যান্য পরিচিত ভবন লোকেট করা — এ সবই আনন্দ এবং উত্তেজনার একটা অদ্ভুত মিকশ্চার হৃদয়ে তৈরি করে। নিজেকে মনে হয় ডানাবিহীন পাখি।
তাই সুদূর প্রাচীনকাল থেকে মানুষ চেষ্টা করেছে নিজের দেহের সঙ্গে ডানা লাগিয়ে অথবা ডানার বদলে যন্ত্রের সাহায্যে আকাশের উড়তে। পঞ্চদশ শতাব্দীর ইটালিয়ান পেইন্টার, ভাস্কর, আর্কিটেক্ট ও ইনজিনিয়ার লিওনার্দো ডা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) লিখেছেন এরোনটিকক্স বিষয়ে। যুগে যুগে মানুষের বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টের পরিণতিতে এরোনটিক্সে স্বশিক্ষিত দুই আমেরিকান ভাই অরভিল রাইট (১৮৭১-১৯৪৮) এবং উইলবার রাইট (১৮৬৭-১৯১২) প্রথম প্লেনে আকাশে ওড়েন। স্থানটি ছিল কিটি হক। তারিখটি ছিল ১৭ ডিসেম্বর ১৯০৩। অর্থাত্ এখন থেকে প্রায় ১১১ বছর আগে।
তারপর যাত্রীবাহী কমার্শিয়াল প্লেনের বহু উন্নতি হয়েছে। প্রপেলার প্লেন, যেমন ডাকোটা থেকে এসেছে জেট-প্রপ প্লেন, যেমন বৃস্টল ব্রাবাজন। জেট প্রপ থেকে এসেছে জেট এবং জাম্বো জেট, যেমন মালয়েশিয়ার এমএইচ-৩৭০ বোয়িং ৭৭৭-২০০। এসব প্লেন ক্রমেই আরও উঁচুতে এবং আরও স্পিডে উড়েছে। আরও যাত্রী নিয়েছে। যেমন, এয়ারবাস এ৩৮০ সর্বোচ্চ ৮৫৩ যাত্রী নিয়ে উড়তে পারে। এই প্লেনের দুটি তলাতে যাত্রীদের বসার এবং শোওয়ার (উন্নত শ্রেণীতে) ব্যবস্থা আছে। নিচের তলাগুলোতে থাকে ব্যাগেজ। প্রতিটি যাত্রীর জন্য আছে নিজস্ব টিভি। বলা যায়, এ ধরনের জাম্বো জেটগুলো ফ্লাইং হোটেল। এ-৩৮০ ঢাকার রূপসী বাংলা হোটেলের (যেটা আগে শেরাটন এবং তারও আগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছিল) তিন গুণ বেশি গেস্ট/যাত্রীকে তাদের খাবার এবং মালপত্রসহ আকাশে ৮,৫০০ মাইল উড়িয়ে নিয়ে গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দিতে পারে। ভেবে দেখুন, তিনটি রূপসী বাংলা হোটেল এক হয়ে আকাশে উড়ছে!
আর এ জন্যই আমি প্রায়ই তরুণ প্রজন্মকে বলি, বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতি বুঝতে হলে প্লেনে অবশ্যই চড়তে হবে। আমি নিজে এই বিশেষ অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওড়ার চেষ্টা করেছি। ১৯৫৭-তে বিওএসি-র (পরে যেটা বৃটিশ এয়ারওয়েজ হয়েছে) বৃস্টল ব্রাবাজন প্লেনে ফাই করে ইওরোপে গিয়েছিলাম। সর্বশেষ এমিরেটস এয়ারলাইনসের এয়ারবাস এ৩৮০-তে ফ্লাই করে লন্ডন থেকে দুবাই গিয়েছি।
প্লেনের প্রতি বিশেষ আগ্রহের কারণে আমার বেশ কয়েকজন পাইলট বন্ধুও হয়েছেন, যেমন, অতীতে পিআইএ’র তথা বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন মজহার (খোকা), ক্যাপ্টেন ইদরিস তালুকদার, ক্যাপ্টেন মাহমুদুল আমিন থেকে শুরু করে বর্তমানে নভোএয়ারের ক্যাপ্টেন রেজাউর রহমান। ক্যাপ্টেন রেজার উদ্যোগে ঢাকায় উত্তরাতে পাইলটদের একটি নিজস্ব ক্লাব প্রতিষ্ঠায় অংশ নিতে পেরে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেছিলাম।
দ্বিতীয়ত, যদিও ১০ মার্চ ২০১৪ থেকে ২৬ মার্চ ২০১৪ পর্যন্ত আওয়ামী সরকার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিহীন একটি তথাকথিত বিশ্ব রেকর্ড গড়ার জন্য আড়াই লাখের কিছু বেশি মানুষকে (২,৫৪,৬৮১) ঢাকায় সমবেত করতে ব্যস্ত ছিল এবং এমএইচ-৩৭০ বিপর্যয়ের তাত্পর্য অনুধাবনে সম্ভবত অলস ছিল তখন প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল প্রায় পৌনে এক কোটি।
এদের অনেকেই স্বদেশে আসা-যাওয়া করেন। কেউ বা দুই-তিন বছরে একবার। কেউ বা বছরে তিন বা আরও বেশি বার। খুলনার জামিরা ইউনিয়নের বিএনপিপন্থী চেয়ারম্যান ড. মামুন রহমান লন্ডনে চার্টার্ড একাউন্টেসি পেশায় রত। তিনি প্রতি মাসে ঢাকায় আসেন। তিনি আসেন একা। অনেকেই আসেন সপরিবারে। রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে এরা নিয়তই প্লেনে আসা-যাওয়া করছেন। এমএইচ-৩৭০-এর যাত্রীদের মতো এরাও যে কোনো সময়ে বিপদে পড়তে পারেন। আফটার অল, মানবদেহ যেমন যে কোনো সময় অচল হতে পারে, ঠিক তেমনই মানব নির্মিত যন্ত্র যে কোনো সময়ে বিকল হতে পারে। প্রশ্ন হলো, এরা বিপদে পড়লে সেটা সামলানোর জন্য বাংলাদেশের কার এবং কি দক্ষতা আছে? কেউ কি লক্ষ্য করেছেন মালয়েশিয়া সরকার এবং মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ বিশ্বজুড়ে কত কঠিন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন এবং কত নম্র, ভদ্র ও শান্তভাবে সেসবের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রাভেলের কারণে বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ নয়। বাংলাদেশ বিমানেরও একই মডেলের প্লেন বোয়িং-৭৭৭ আছে। এই প্লেনে বাংলাদেশী এবং বিদেশীরা ট্রাভেল করছেন। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিভিন্ন দেশে এবং বোয়িং নির্মাতা আমেরিকাতেও বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে হবে। এবং সেটা মার্জিত ভাষায় সুচিন্তিতভাবে করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লিসেন, লিসেন অথবা মুই, হনু, ছ্যাপ, মার্কা ভাষায় নয়। জবাবদিহি করতে হবে মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের মতো শালীন ও নম্র ভাষায়। পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের উত্তেজনাপূর্ণ ভাষায় নয়, মালয়েশিয়ান ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রী হিশামুদ্দিন হুসেইনের মতো সহানুভূতিপূর্ণ শান্ত ভাষায়। জবাবদিহি করতে হবে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস গ্রুপের সিইও মোহাম্মদ জাওদাইয়ের মতো তথ্যপূর্ণ ভাষায়।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বিমানের কোনো ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) অথবা সিইও হয়তো নেই। ২৩ মার্চ ২০১৪-তে বাংলাদেশ বিমানের এমডি কেভিন স্টিল পদত্যাগ করেছেন। এই বৃটিশ ছিলেন বাংলাদেশ বিমানের প্রথম বিদেশি এমডি। মাত্র এক বছর কাজ করার পর তিনি পদত্যাগ করলেন অথবা করতে বাধ্য হলেন। সাম্প্রতিককালে যারা লন্ডন-ঢাকা-লন্ডন রুটে বিমানে ফ্লাই করেছেন তারা প্রায় সবাই বলেন কেভিন স্টিল ইনচার্জ হওয়ার পর বিমানের ফ্লাইট শেডিউল অনেকটা নিয়মিত হয়ে আসছিল এবং যাত্রীসেবার মান উন্নত হচ্ছিল। ফলে বিমানের যাত্রী সংখ্যা বাড়ছিল এবং সম্ভবত বিমানের ক্ষতির পরিমাণ কমছিল। কিন্তু আওয়ামী সরকারের প্রাণকেন্দ্র দিল্লিতে বিমানের ফ্লাইট নিয়ে সরকারের সঙ্গে ভিন্ন মতের কারণে কেভিন স্টিল পদত্যাগ করেন বলে কিছু সূত্র দাবি করেছে। এই সূত্রগুলোর মতে, ঢাকা-দিল্লি-ঢাকা রুটে বিমানের ফ্লাইটে ক্ষতি হয়। তাই কেভিন স্টিল এই রুটে ফ্লাইট বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার এতে রাজি হয়নি। ফলে এক যোগ্য এমডিকে বাংলাদেশ বিমান হারিয়েছে। বিষয়টি অন্যদিকে নেয়ার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ বলেছে, স্বাস্থ্যগত কারণে কেভিন স্টিল পদত্যাগ করেছেন।
তৃতীয়ত, এমএইচ-৩৭০ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় রিপোর্টিং স্টাইল ও কনটেম্লটস ছিল শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয়। বিবিসি ওয়ার্ল্ড তাদের নিউজ প্রোগ্রামে অন্যান্য সংবাদ খুব সংক্ষিপ্ত করে দিনের পর দিন বড়ভাবে কভার করেছে মালয়েশিয়া এলারলাইনস সন্ধান প্রচেষ্টা, নিখোঁজ যাত্রীদের আত্মীয়স্বজনের প্রতিক্রিয়া এবং এভিয়েশন এক্সপার্টদের মতামত। বিবিসি কিছু নিউজ ব্রডকাস্টিংয়ে নিউজকাস্টারদের পেছনে (ব্যাকড্রপে) বড় বড় অক্ষরে মঙ্গল কামনা করেছে প্রে ফর এমএইচ-৩৭০, Pray For MH-370 লিখে।
প্লেনটি নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত ১০টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে বিবিসি। এটির বাংলা অনুবাদ নিচে প্রকাশিত হলো। আমেরিকার প্রভাবশালী ম্যাগাজিন টাইম কভারস্টোরি করেছে যার শিরোনাম, The mystery of flight 370 বা ফ্লাইট ৩৭০ রহস্য। এই কভারস্টোরির অনুবাদও নিচে প্রকাশিত হলো। টাইম তার কভারের ছবির জন্য বিখ্যাত। তার অনেক কভারই হয় চোখ ধাধানো। কিন্তু এবার তারা ফ্লাইট-৩৭০ রহস্য বোঝানোর জন্য এক ধরনের চোখের ধাধা দিয়ে কভার করেছে। কভারটি পুনঃমুদ্রিত হলো ছোট আকারে। নয়া দিগন্ত’র ছাপা যদি ভালো হয় তাহলে পাঠকরা লক্ষ্য করবেন খাড়াখাড়ি সরলরেখাগুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি বোয়িং-৭৭৭।
১৯৫৪ থেকে আমি টাইম নিয়মিত পড়ছি। কিন্তু এত কেভার কভার দেখেছি বলে মনে পড়ে না। পাঠকরা ইন্টারনেটে গিয়ে কালারে কভারটি দেখলে বিষয়টি বুঝবেন।
প্যারেড গ্রাউন্ডে লোক দেখানো দেশপ্রেমের অজুহাতে জিরো প্লাস জিরো প্লাস জিরো ইকোয়াল টু জিরো মানুষের গুরুত্বহীন সমাবেশ না ঘটিয়ে আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত মালয়েশিয়া, বিবিসি, টাইমের মতো দক্ষ, যুক্তি ও তথ্যশালী লোকবল সৃষ্টি করা, যার ফলে সম্ভব হবে দুর্যোগ ও বিপর্যয়গুলো সমন্বিত ও সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলা করা।
টাইম কভার দি মিস্টৃ অফ ফ্লাইট ৩৭০ শুনলে মনে হবে এটা লস্ট (Lost) নামে মুভিটির একটি রিয়াল-লাইফ কাহিনী। ১৯৫৫-র লস্ট মুভিতে একটি ধনী পরিবারের শিশুকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল এক বুয়া। সেই বুয়া একটু অন্যদিকে তাকাতেই নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায় সেই শিশুটি। তারপর চলতে থাকে শিশুকে খোঁজার জন্য পরিবার এবং পুলিশের আপ্রাণ চেষ্টা।
২৭২ টন ওজনের বোয়িং-৭৭৭ এভিয়েশনের অতি নির্ভরযোগ্য প্লেন। কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করল বেইজিংয়ের উদ্দেশে। ফ্লাইটের এক ঘণ্টা পুরো না হতেই প্লেনটি অদৃশ্য হয়ে গেল এয়ার ট্রাফিক রেডার স্কৃন থেকে। শুরু হয়ে গেল ২৬টি দেশের টেকনলজিকাল সাজ-সরঞ্জামের খোঁজার চেষ্টা। অংশ নিল বহু হাইটেক যুদ্ধ-জাহাজ, খুব সফিসটিকেটেভ সুপারসনিক জেট প্লেন, সবদিকে দৃষ্টিব্যাপী সব স্যাটেলাইট। দিনের পর দিন চলে গেল। কিন্তু এয়ারলাইনারের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। বিশ্বজুড়ে গোয়েন্দা দাদারা বহু খুঁজলেন, ওপর-নিচে সব দিকে। কিন্তু তারা কিছুই পেলেন না। ৮ মার্চ ২০১৪-র মাঝ রাতের পর পরই মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস ফাইট ৩৭০-এর সঙ্গে বিশ্বের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তখন প্লেনটির অবস্থান ছিল মালয়েশিয়া এবং ভিয়েতনামের আকাশসীমার ঠিক মাঝখানে। বলা যেতে পারে নো ম্যানস স্কাই (No Man’s sky)-তে।
অন্ধকার রাত থেকে আলোর প্রভাতের মধ্যের সময়টিতে সেই প্লেনের কি হয়েছিল সে বিষয়ে এরপর প্রতিদিন নতুন সব থিওরি আসতে থাকে। ওই প্লেনটিকে হাইজ্যাক করে কোনো দূরবর্তী ল্যানডিং স্টৃপে নামানো হয়েছে? যদি তাই হয় তাহলে যাত্রীরা কোথায়? অথবা প্লেনটির যন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়ার ফলে সমুদ্রে ক্র্যাশ করেছে? তাই যদি হয়, তাহলে ধ্বংসাবশেষ (We Debris) কোথায়? সার্চ টিমগুলো এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে কাজে লেগে যায়। এমএইচ-৩৭০ বিষয়ে তাদের সংগৃহীত সর্বশেষ তথ্যগুলো জানতে লাখ লাখ বিশ্ববাসী উদগ্রীব হয়ে থাকে। তারা ভাবতে থাকে এই ২০১৪-তে টেকনলজি এত অভাবগ্রস্ত কেন, যার ফলে ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে ২০৯টি (৬৪ মিটার) লম্বা এক০টি এয়ারলাইন আধুনিক এভিয়েশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় অদৃশ্য থাকতে পারে।
আমাদের এই সবজান্তা যুগে এমএইচ-৩৭০-এর অদ্ভুত কাহিনী খাপ খায় না। আমরা যখন জীবন যাপন করি তখন কোটি কোটি মানুষকে বিশ্বের ইনটেলিজেন্স এজেন্সিগুলো দেখতে পারে, শুনতে পারে। এমনকি আমরা যারা স্পাই নই তাদের কাছেও বহু রকমের ট্র্যাকিং টেকনলজি আছে। আইফোন হারিয়ে গেলে কিছু ওয়েবসাইটে গিয়ে কিবোর্ড টেপাটেপি করলে সেটা পেতে পারি, যেসব স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে তাদের ট্র্যাক করতে পারি, গুগল ম্যাপ দিয়ে বহু দূরের স্থানগুলো আবিষ্কার করতে পারি। তাহলে বিটস ও বাইটস-এর (Bits and Bytes) যে অতি জটিল ও বিস্ময়কর অবকাঠামো আমরা বানিয়েছি তা সত্ত্বেও আমরা কেন একটা জাম্বো জেটকে ট্র্যাক করতে পারলাম না?
উত্তরগুলো উদ্বেগজনক। লাইন ইলেভেনে (১১ সেপ্টেম্বর ২০০১)-এ নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পরে বিশ্বজুড়ে এয়ারপোর্টে যখনই আমরা প্লেনে উঠতে যাই তখন প্রতিবারই বিভিন্ন ধরনের সিকিউরিটি প্রটোকল আমাদের মানতে হয়। কিন্তু আকাশে ভাসমান অবস্থায় আমাদের ট্র্যাক করার জন্য টেকনলজিগুলো সাধারণ। এসব বেসিক টেকনলজিগুলো নিশ্ছিদ্র নয়। আমাদের সবচেয়ে আধুনিক এয়ারক্রাফটকেও অদৃশ্য করে দিতে পারে মানুষের হাত। এমএইচ-৩৭০ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক এ বিষয়ে তার প্রথম সরকারি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। এটা ছিল ওই প্লেনে কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কাজের ফল।
আকাশে ওড়ার প্রায় এক ঘণ্টা পরে, রাত ১২ : ৪১ মিনিটে এয়ারক্রাফটের যোগাযোগ করার দুটি প্রধান যন্ত্র সুইচ অফ করে দেয়া হয়। এই দুটি যন্ত্র হচ্ছে, স্বয়ংক্রিয় অটোমেটেড এয়ারক্রাফট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড রিপোর্টিং সিস্টেম (সংক্ষেপে একার্স, ACARS) এবং ট্রান্সপনডার যা উড়ন্ত প্লেনের এক ধরনের বিশেষ সিগনাল মাটিতে অবস্থানকারী গ্রাউন্ড কনট্রোলকে পাঠায়। মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের পরবর্তী বিবৃতিগুলো জানায়, রাত ১.১৯ মিনিটে প্লেনের কো-পাইলট ফরিক আবদুল হামিদ, এমএইচ-৩৭০ থেকে এয়ার ট্রাফিক কনট্রোলকে বলেন, ‘অল রাইট, গুড নাইট।’ এটাই ছিল এমএইচ-৩৭০ থেকে জানা মতে শেষ কথা। (প্লেনের পাইলট জাহারি আহমদ শাহ (৫৩)-র আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা ছিল ৩৩ বছরের। এই সময়ের মধ্যে তিনি ১৮ হাজার ফ্লাইট আওয়ার্স উড়েছিলেন)। এরপর প্লেনটি তার পূর্বনির্ধারিত ফ্লাইট পথে থেকে সরে যায়। ফ্লাইট সিস্টেম যে জানে এমন কোনো ব্যক্তি ওই প্লেনের কমপিউটারে নতুন প্রোগ্রাম পাঞ্চ করেছিল। তাই এমএইচ-৩৭০ উত্তরে চায়নার পথে না গিয়ে হঠাত্ পশ্চিমে মোড় নিয়ে এগোতে থাকে মালয়েশিয়া উপদ্বীপের দিকে। তারপর প্লেনটি মালাক্কা প্রণালি পেরিয়ে যায়। বিশ্বের অতি ব্যস্ত শিপিং লেইনের অন্যতম মালাক্কা প্রণালি।
কয়েক দিন পরে জানা যায়, ওই প্লেনের যাত্রাপথে ট্র্যাক করেছিল একট ধারাবাহিক ইলেকট্রনিক হ্যান্ডশেক। একটা মোবাইল ফোন, যেমন একটা অজানা ক্যারিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে ঠিক তেমনি এমএইচ-৩৭০ থেকে এই হ্যান্ডশেক করা হয়েছিল একটি কমার্শিয়াল স্যাটেলাইট সিস্টেমের সঙ্গে। কিন্তু মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই স্যাটেলাইট সিস্টেমের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিল না। এ ধরনের হ্যান্ডশেককে পিং (Ping) বলা হয়। সর্বশেষ স্যাটেলাইট পিংটি হয় ৮ মার্চ সকাল ৮.১১ মিনিটে। প্রাপ্ত তথ্য বলে, এই প্লেন জার্নির সম্ভবত শেষ স্থানটি হতে পারে মধ্য এশিয়া থেকে ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে ৩০ লক্ষ বর্গমাইল বিস্তৃত যে কোনো জায়গায়।
কে নজর রাখছে আকাশে?
যদি প্লেনটি উত্তর-পশ্চিমের দিকে মোড় নিত এবং মধ্য এশিয়ার দিকে এগিয়ে যেত তাহলে ইনডিয়া, পাকিস্তান ও চায়নার রেডার সিস্টেমে সেটা ধরা পড়ত। আফগানিস্তানে আমেরিকান ঘাটিগুলোর রেডারেও ধরা পড়ত। অথবা ধরা পড়ত না। সত্যটা হচ্ছে এই যে, আমাদের আকাশ লক্ষ্য করার জন্য অবকাঠামো বা ইনফ্রাস্ট্রাকচার হয়েছে গত কয়েক যুগ ধরে একটু একটু করে। এর সঙ্গে আধুনিক কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি যুক্ত করার কোনো আইন হয়নি। প্লেনে এসব যন্ত্রপাতি ফিট করারও খুব ব্যয় সাপেক্ষ।
রবার্ট বেনজন, যিনি ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (সংক্ষেপে এনটিএসবি, NTSB)-এ এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট ইন্সপেক্টর পদে ২৫ বছর কাজ করেছেন, তিনি বলেন, আমাদের ব্যবসায়ে এক ধরনের কবর ফলক (Tombstone) মানসিকতা আছে। কোনো কিছু করার জন্য আগে দরকার মাটিতে রক্ত অথবা মরা মানুষ। যখন সব কিছুই ঠিক মতো চলে, তখন কোনো কিছু বেঠিক হবে এমন সম্ভাবনার ওপর টাকা খরচ করাটা খুবই দুষ্কর।
তার এ কথায় যদি বিচলিত না হন, তাহলে এটা ভাবুন : কিছু রেডার সিস্টেম সুইচড অফ রাখা হয়। স’ানীয় কোনো টেনশন হলে তখন এই সিস্টেমের পাওয়ার অন করা হয়। সার্বক্ষণিকভাবে এয়ার-সারভেইলান্স সিস্টেম অন রাখতে অনেক খরচ হয়। তাই সরকারগুলো এই সিস্টেমের সুইচ সাধারণ অফ করে রাখে। এমএইচ-৩৭০ যে এলাকায় নিখোজ হয়ে গিয়েছে সেখানের এয়ার সারভেইলান্স সিস্টেম এমনই ছিল।
এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, যেমন ইনডিয়া ও পাকিসত্মানের মধ্যে, বিষয়টিকে আরো জটিল করেছে। কোনো সরকার যদি মনে করে কোনো তথ্য বা ডেটা সামরিকভাবে তাত্পর্যপূর্ণ তাহলে সেটা তারা অন্য সকারের সঙ্গে শেয়ার করবে না। অথবা ইমার্জেন্সির সময়ে ঢিলেমি করবে। ১৮ মার্চে থাইল্যান্ড জানায়, গ্রাউন্ড কনট্রোলের সঙ্গে এমএইচ-৩৭০-এর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছু পরই হয়তো তাদের একট মিলিটারি রেডার নিখোজ প্লেনটিকে লক্ষ্য করেছিল। এই খবরটির ফলে যদিও এমএইচ৩৭০ সন্ধান কাজের গতিপথ বদলায়নি, তবু থাইল্যান্ড যে ১০ দিন পরে তাত্পর্যপূর্ণ মিলিটারি ইনটেলিজেন্স শেয়ার করতে চেয়েছে, তাতে বোঝা যায় এ ধরনের একটি আন্ত্মর্জাতিক সার্চ কাজকে সমন্বিত করা কত কঠিন।
আন্ত্মর্জাতিক সমুদ্রে সহযোগিতাও জোড়াতালি দিয়ে চলে। তীরে অবস্থিত রেডার ভূমি থেকে ২৫০ মাইলের (৪০০ কিমি) বেশি কার্যকর নয়। তার মানে একটি ফাইটকে ট্র্যাক করতে বিভিন্ন গ্রাউন্ড স্টেশন বিভিন্ন সময়ে কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। এর ফলে একটা প্লেনের গতিপথ সম্পূর্ণভাবে ট্র্যাক করা সম্ভব না-ও হতে পারে।
‘যে টেকনলজি ৭০ বছরের বেশি পুরনো সেটা পাহাড়ের মধ্যে কাজ করে না এবং পৃথিবীর গোল আকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে বাকাতে পারে না। একটা এয়ারক্রাফট যখন একটি দুর্গম এলাকার ওপর দিয়ে অথবা সমুদ্রের ওপর দিয়ে যায়, তখন তাকে ট্র্যাক করার কোনো সিস্টেম আসলেই নেই।’ এ কথা বলেন আমেরিকার ডেটোনা বিচে এমবৃ রিডল এরোনটিকাল ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্টান্ট প্রফেসর ডেভিড আইসন।
আরো আধুনিক টেকনলজি এখন পাওয়া যায়। কিন্‘ এয়ারলাইন ইনডাস্টৃ সেটা নেয়নি। আমেরিকায় ফোর্ট ওয়ার্থে এভিয়েশন এক্সপার্ট এবং রিটায়ার্ড মেরিন পাইলট উইলিয়াম লরেন্স বলেন, ‘এখন আমাদের যে টেকনলজি আছে সেটা দিয়ে রিয়াল টাইম জিপিএস (GPS) ট্র্যাকিং সার্ভিস সম্ভব। এই ধরনের একটা সিস্টেম আছে। যার নাম অটোম্যাটিক ডিপেনডেন্ট সারভেইলান্স ব্রডকাস্ট (সংক্ষেপে এডিএস-বি, ADS-B)। কিন্তু কনটিনেন্টাল আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু স্থান এখনো রেডার এবং রেডিও-র ওপর নির্ভর করে। আমেরিকার ফেডারাল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ২০২০-এর মধ্যে এডিএস-বিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্ল্যান করেছে।’
সর্বাধুনিক টেকনলজি প্লেনে যুক্ত করা এয়ারলাইনসগুলোর জন্য খুবই ব্যয় সাপেক্ষ। এমএইচ-৩৭০ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস অর্থ কষ্টে ছিল। একটা জেট প্লেন আর একটা আইফোন সমান নয়। একটা জেটের কর্মজীবন ৩০ থেকে ৪০ বছর। একটা প্রডাক্ট ডেভেলপ করতে সময় লাগে। রিসার্চ থেকে প্লেনে সেই প্রডাক্ট বসাতে এক যুগ সময় লাগতে পারে। কোনো এয়ারলাইনের সব প্লেনকে সর্বাধুনিক এভিওনিক্স (Avionics) দিয়ে আপগ্রেড করতে অনেক খরচ হয়। শুধু ভেবে দেখুন, একটা জেট প্লেনে ওয়াই-ফাই বসাতে খরচ হতে পারে ২৫০,০০০ ডলার।
সেখানে একটা অফ সুইচ কেন?
কেউ সুইচ অফ না করা পর্যন্ত আধুনিক জিপিএস সিস্টেমগুলো কাজ করে। যেমন ব্যাটারি চার্জ সেভ করার জন্য আমরা অনেকেই স্মার্টফোন অফ করে রাখি। প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এমএইচ-৩৭০ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে আপনি জানতেন না একটা এয়ারলাইনারের প্রায় সব কমিউনিকেশন সিস্টেম বন্ধ রাখা যায়। ‘একজন পাইলট যে শুধু প্লেনের ট্রান্সপনডার সুইচ অফ করতে পারেন তাই নয়, তিনি ফ্লাইট রেকর্ডার (যেটি ব্ল্যাক বক্স নামে পরিচিত)-ও অচল করে দিতে পারেন। প্লেন আকাশে ওড়ার সময় কি হচ্ছে তা রেকর্ড করে ব্ল্যাক বক্স।’ এ কথা বলেন ব্ল্যাক বক্স বিষয়ে রিটায়ার্ড এনটিএসবি এক্সপার্ট জিম ক্যাশ। তিনি আরো বলেন, ‘ব্ল্যাক বক্স ঠিক মতো কাজ করলেও, যদি সেটা না পাওয়া যায় তাহলে কোনো লাভ হয় না। এমএইচ-৩৭০-এর ব্ল্যাক বক্স সার্চ লাইট বিকিরণ করবে ৩০ দিন। তবে পানির নিচে এর অবস্থান হতে হবে ২ মাইলের (৩.৫ কিমি) কম। ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ দিকে গড় গভীরতা ২ মাইলের বেশি। দক্ষিণ-পশ্চিমের এয়ারকরিডর বরাবর ফাই করেছিল এমএইচ-৩৭০। তারপর হয়তো ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে ক্র্যাশ করেছিল। সে ক্ষেত্রে তার ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হবে খুবই কঠিন চ্যালেঞ্জ।’
প্রশ্ন হচ্ছে, প্লেনের অবস্থান নির্ণয়কারী এমন যন্ত্র কেন প্লেনে থাকে যেটা বন্ধ করে দেয়া যায়? একটা উত্তর হলো : ইচ্ছাকৃতভাবে এই সিস্টেম ধ্বংস করা খুবই বিরল এবং তাই হয়তো এটা বদলানোর বিষয়ে কেউ ভাবেনি। তা ছাড়া ট্রান্সপনডারে আগে থেকেই অফ সুইচের ব্যবস্থা ছিল যেন সেটা এয়ারপোর্টের রেডারে কোনো বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। এয়ারপোর্টের নতুন রেডার সিস্টেম প্লেনের আলো বিকিরণে কনফিউজড হয় না। কিন্তু, তা সত্ত্বেও বড় কমার্শিয়াল এয়ারলাইনে এখনো অটোমেটেড ট্রান্সপনডার লাগানো হয়নি, যেটা প্লেন আকাশে ওড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করে দেয়।
এমএইচ৩৭০-এর ককপিটে মানুষের হস্তক্ষেপ হয়েছিল এমনটা ধারণার পর বিশ্ব জুড়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয় কে বা কারা এটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করেছিল এবং কিভাবে তারা প্লেনটিকে রেডারের নিচ দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ওই পেস্ননের ক্যাপ্টেন অথবা কো-পাইলট কি সুইসাইডাল ছিলেন? অথবা উগ্রপন্থী ফ্যানাটিক? অথবা ওই প্লেনের কোনো প্যাসেঞ্জার যার এভিয়েশন বিষয়ে এক্সপার্টিজ ছিল। সে কি জোর করে ককপিটে ঢুকে গিয়েছিল? এটা মনে হচ্ছে প্লেনটা উত্তর করিডর দিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে যায়নি। উত্তর করিডরে বহু দেশের মিলিটারি রেডার আছে। বরং পেস্ননটি দক্ষিণ করিডর দিয়ে ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ দিকে গিয়েছিল যেন তাকে কেউ লক্ষ্য না করতে পারে। আরেকটি থিওরিতে বলা হয় হয়তো প্লেনটি অপর একটি প্লেনের খুব পিছু পিছু গিয়েছিল, যার কারণে রেডারে বোঝা সম্ভব হয়নি।
এমএইচ৩৭০ মহাসাগরে ক্র্যাশ করেছে এমন সম্ভাবনায় অনেকে মনে পড়ে যায় এয়ার ফ্রান্স ফাইট ৪৪৭-এর কথা। ২০০৯-এ রিও ডি জ্যানেরো থেকে প্যারিসের যাত্রাপথে ওই পেস্ননটি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ দুটি ঘটনার মধ্যে বড় কিছু তফাত আছে। মন্দ আবহাওয়া, পাইলটদের ভুলভ্রান্তি এবং এয়ারস্পিড পড়তে ভুল করা — সম্মিলিতভাবে এই তিনটি কারণে ফাইট ৪৪৭ দক্ষিণ আটলান্টিকে ডুবে গিয়েছিল। ফলে প্লেনের ২২৮ যাত্রী নিহত হয়েছিল। ওই প্লেনের ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করতে দুই বছর সময় লাগে। কিন্‘ সেটা সম্ভব হয়েছিল এ কারণে যে বস্ন্যাক বক্স ১৩,০০০ ফিট (৩,৯৬০ মিটার) পানির নিচে ছিল এবং তদন্তকারীরা জানতেন যে ঠিক কোথায় খুজতে হবে। বেনজন বলেন, ‘এয়ার ফ্রান্সের ক্ষেত্রে বিনা বিলম্বে ভাসমান ধ্বংসাবশেষ দেখা গিয়েছিল। ওতেই বোঝা যায় মহাসাগরের কোন জায়াগায় সার্চ করতে হবে।’
এমএইচ৩৭০ রহস্য বিশ্ব জুড়ে এয়ারপোর্টগুলোর সিকিউরিটি ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নাইন ইলেভেনের (১১ সেপ্টেম্বর ২০০১) পরে আমরা অভ্যসত্ম হয়ে গিয়েছি ট্রান্সপারেন্ট ব্যাগে প্রসাধনী সামগ্রী প্যাক করতে এবং সিকিউরিটি গেইটের নিচে দাড়িয়ে কেউ কিছু বলার আগে দুই হাত তুলে দাড়াতে। কিন্তু তার পরও এমএইচ৩৭০-এ দুজন যাত্রী চোরাই পাসপোর্টে ফাই করছিল। প্লেনটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর পরই খবরটি প্রকাশিত হয়। সবার চোখ তখন পড়ে ওই দুই যাত্রীর প্রতি। পরে জানা যায়, তারা ছিল তরুণ ইরানি। তারা ইওরোপে যেতে চাচ্ছিল অবৈধ ইমিগ্রান্ট রূপে নতুন জীবন শুরু করার জন্য। তারা টেররিস্ট ছিল না। কিন্তু তারা যে এত সহজে সব ইমিগ্রেশন চেক এড়িয়ে প্লেনে চড়তে পেরেছিল সেটা উদ্বেগের বিষয়। ইন্টারপোল একটি ডেটাবেইসে প্রায় চার কোটি চুরি হওয়া অথবা হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্টের লিস্ট রেখেছে। এমএইচ৩৭০-এ যে দুটি চোরাই পাসপোর্ট ব্যবহার করা হয়েছিল তার বিবরণও সেই ডেটাবেইসে আছে। কিন্তু বিশ্বের ২০টির কম দেশ এই ডেটাবেইসে রেজিষ্ট্রি করিয়েছে। মালয়শিয়ানরা যে ইন্টারপোলের এই তথ্য সম্ভার কাজে লাগায়নি সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
মানুষের পক্ষে বোধগম্য নয় বিভিন্ন নিরাপত্তা, সিস্টেম ও টেকনলজি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেও সেটা বাস্তবায়িত হবে ভবিষ্যতে। এমএইচ৩৭০-এ যারা নিখোজ হয়ে গিয়েছেন তাদের পরিবারের দুঃখ-দুর্দশা এতে কমবে না। এদের অধিকাংশ, ১৫৩ জন, ছিলেন চায়নিজ। বেইজিংয়ের একটি হোটেলে এদের এনে রাখা হয়েছিল। তারা মনে করেন মালয়শিয়া এয়ারলাইনসের স্টাফরা তথ্য গোপন রেখেছেন। ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ আত্মীয়রা ওই স্টাফদের প্রতি মিনারাল ওয়াটার বটল ছুড়ে মারেন।
ই-র দুলাভাই চেন জিয়ানশি (৫৮) ওই প্লেনের যাত্রী ছিলেন। ই বলেন, আত্মীয় পরিবারদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে। তারা প্রতিটি পরিবারের গলায় যেন একটা ফাসির দড়ি পরিয়ে রেখেছে আর প্রতিদিন আসেত্ম আস্তে টানছে। গলায় ফাসটা আরো টাইট হচ্ছে।
যাত্রীদের অনেকেই ছিলেন চায়নার নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এবং বিদেশ ভ্রমণে এয়ার ট্রাভেল ছিল তাদের জন্য একটি নতুন আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। এদের আত্মীয়দের অনেকেই এখনো চায়নায় চাষবাস ও কারখানার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আনস্মার্ট পোশাকে এরা হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ান। তাদের দেখে ক্লান্ত মনে হয়। মালয়শিয়া এয়ারলাইনস ওই গ্র্যান্ড বলরুমকে তাদের কমান্ড সেন্টার করেছে। কিন্তু এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কমান্ড করার মতো খুব কম তথ্য তাদের কাছে ছিল। আত্মীয়রা গ্রামীণ হন অথবা শহুরে হন, তারা কেউই বুঝতে পারছিলেন না এমএইচ৩৭০ কেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। (টাইম ম্যাগাজিন ডেটলাইন ৩১ মার্চ ২০১৪ যদিও এটি ঢাকায় প্রচারিত হয় ২৫ মার্চ ২০১৪-তে) সর্বশেষ সংবাদ ২৬ মার্চে জানা যায় ফ্রান্সের একট স্যাটেলাইট থেকে গৃহীত ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে প্রায় ১২০টি ভাসমান বস্তুর ফটো তদন্তকারী দলকে দেওয়া হয়েছে। এই রিপোর্ট লেখার সময়ে ২৭ মার্চে জানা গেছে থাইল্যান্ডের থাই স্পেস এজেন্সি দক্ষিণ ভারত মহাসগরের প্রায় একই স্থানে ২০০ থেকে ৩০০ ভাসমান বস্তুর ফটো তুলে তদন্তকারী দলকে পাঠিয়েছে। কিন্তু মহাসাগরের ওই এলাকায় আবহাওয়া খুব খারাপ থাকায় উদ্ধারকারীরা সেখানে যেতে পারেননি। পাচটি জাহাজ এবং বহু প্লেন উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছে। ইতিমধ্যে ব্ল্যাক বক্স উদ্ধারকারীদের একটি বিশেষ টিম আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়াতে এসে পৌছেছে।
১০ টি প্রশ্নের উত্তর
১. প্লেনটি কেন বাম দিকে ঘুরল
ফাইট এমএইচ৩৭০ যাচ্ছিল উত্তর-পূর্ব দিকে। মিলিটারি রেডার লগে দেখা যায় অপ্রত্যাশিতভাবে এটি পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরে যায়। এর আগেই প্লেনের ট্রান্সপনডার সুইচ অফ করা হয়েছিল এবং প্লেন থেকে সর্বশেষ একার্স (ACARS) ডেটালিংক ট্রান্সমিশন পাঠানো হয়েছিল। ব্রম্ননাই ইউনিভার্সিটির ফাইট সেফটি ল্যাব-এর ড. গাই গ্র্যাটন বলেন, এ ধরনের ঘুরে যাওয়া খুব কমই ঘটে। এর প্রধান কারণ হতে পারে প্লেনে কোনোরকম সিরিয়াস সমস্যা দেখা দিলে পাইলট ভিন্ন গন্তব্যস্থলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যেন প্লেনটাকে দ্রুত মাটিতে নামানো সম্ভব হয়। ক্র্যানফিল্ড ইউনিভার্সিটি (ইউকে)-র ফাইট ডেটা মনিটরিং এক্সপার্ট ডেভিড ব্যারি বলেন, প্লেনের খুব কাছাকাছি অন্য আরেকটি প্লেন এসে পড়লে অথবা হঠাত্ ডিকমপ্রেশন হলে পাইলট এভাবে প্লেনের গতিপথ বদলাতে পারেন। তবে পাইলটের অথবা অন্য কোনো অনাহূত ব্যক্তির কুইচ্ছার ফলেও এমনটি ঘটতে পারে। কিন্তু ব্ল্যাক বক্স বা ফাইট রেকর্ডার না পাওয়া পর্যন্ত জানা যাবে না ওই সময়ে ককপিটে কি ঘটেছিল।
২. পাইলট কি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন?
মিডিয়াতে কেউ কেউ বলেছেন এমএইচ৩৭০-এর নিখোজ হওয়ার কারণ হতে পারে পাইলটের সুইসাইড। সেটা হলে এই প্রথম হবে না। ধারণা করা হয়, ১৯৯৭-এ সিল্ক এয়ার ফাইট ১৮৫ এবং ১৯৯৯-এ ইজিপ্ট এয়ার ফাইট ৯৯০ দুটিই ক্র্যাশ করেছিল পাইলটের ইচ্ছায়। তবে এই মতের বিরুদ্ধে অন্য মতামতও এসেছে। এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্ক বলছে, ১৯৭৬ থেকে আটটি প্লেন ক্র্যাশ করেছে পাইলটের সুইসাইডের জন্য। এমএইচ৩৭০-এর ক্যাপ্টেন জাহারি আহমদ শাহ এবং তার কো-পাইলট ফরিক আবদুল হামিদ-এর বাড়ি সার্চের পর যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে অনুরূপ কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে জল্পনা-কল্পনা হয়েছে ক্যাপ্টেন জাহারি শাহ-র সঙ্গে তার স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর তিনি হয়তো বা মানসিকভাবে আপসেট ছিলেন। কিন্তু এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত তার মানসিক অবস্থা বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। ক্যাপ্টেন শাহ-র বাড়িতে পুলিশ একটা ফাইট সিমুলেটর (একটি যন্ত্র যেটার মাধ্যমে ঘরে বসে কৃত্রিমভাবে প্লেন চালানো প্র্যাকটিস করা যায়) পেয়েছে। পুলিশ ওই যন্ত্রটি পরীক্ষা করে দেখছে। ব্যারি বলেছেন, প্লেনের কিছু সিসটেম যে ইচ্ছা করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল তাতে সুইসাইড থিওরিটা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। কিন্তু অন্য যেকোনো থিওরির মতোই পাইলট সুইসাইডও আরেকটা থিওরি। গ্র্যাটন তার সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, সুইসাইড থিওরি প্রমাণ করা অথবা বাতিল করার মতো কোনো আলামত এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
৩. প্লেনটা কি হাইজ্যাক হয়েছিল?
নাইন ইলেভেনে (১১ সেপ্টেম্বর ২০০১) নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর হাইজ্যাকাররা যেন ককপিটের কনট্রোল না নিতে পারে সে জন্য ফাইট ডেক দরজা খুব মজবুত করে বানানো হয়। ফাইট ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিনের সেফটি এডিটর ডেভিড লিয়ারমাউন্ট বলেন, ওই দরজাগুলো এখন বুলেট প্রুফ তো বটেই — এমনকি কুঠার দিয়েও ভাঙ্গা যাবে না। হোয়াই প্লেনস ক্র্যাশ (কেন প্লেন ক্র্যাশ করে) বইয়ের লেখিকা এবং লাইট এয়ারক্রাফট পাইলট সিলভিয়া রিনলি একমত হয়ে বলেন, ককপিটের দরজা ভেঙ্গে ঢুকলেও পাইলট সময় পাবেন বিপদ সঙ্কেত পাঠাতে।
তবে নাম প্রকাশে অচ্ছুিক একজন পাইলট বলেন, তালা খুলে ফাইট ডেকে ঢোকা সম্ভব। কিন্তু দরজা যতই শক্ত হোক না কেন এক সময়ে সেটা খুলতেই হয়। যেমন, পাইলট টয়লেটে যেতে চাইতে পারেন অথবা ক্যাবিনে কি হচ্ছে সেটা দেখতে যেতে পারেন। ঠিক সেই সময়ে হাইজ্যাকাররা দ্রুত ককপিটে ঢুকে যেতে পারে। ফেব্রুয়ারি ২০১৪-তে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের একটি ফাইটে পাইলটের টয়লেট যাওয়ার জন্য দরজা খোলার অপেক্ষায় ছিল হ্যাইজ্যাকাররা। তারা প্লেনটিকে হাইজ্যাক করে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। এই সম্ভাবনা কমানোর জন্য ইসরেলের এয়ারলাইন এল আল (EL AL)-এ ডাবল দরজার ব্যবস্থা হয়েছে। গ্র্যাটন বলেছেন, যখন দরজা খোলা হবে তখন একজন ক্যাবিন ক্রু যেন সেখানে গার্ড দেন সেই নিয়ম আছে। তা-ও যদি হাইজ্যাকাররা দ্রুত ককপিটে ঢুকে পড়ে তাহলে অন্তত একজন পাইলট বিপদ সংকেত পাঠাতে পারবেন। কোনো পাইলট হয়তো বা কোনো যাত্রীকে ককপিটে বসার অনুমতি দিতে পারেন। জানা গেছে, গত মাসে এমএইচ৩৭০-এর কো-পাইলট, এর আগের একটি ফাইটে এক টিনএজারকে ককপিটে ফটো তোলার পারমিশন দিয়েছিলেন। প্লেন নির্মাতা বোয়িং কম্পানি বলেছে, তদন্ত চলাকালে কোনো মন্তব্য করা উচিত হবে না।
৪. কোনো দুর্ঘটনা কি কারণ হতে পারে?
প্লেনের কমিউনিকেশন সিসটেম ও ট্রান্সপনডার ইচ্ছাকৃতভাবে অচল করে দেয়া হয়েছিল এই থিওরির ওপর ভিত্তি করে তদন্ত চলছে। মালয়শিয়া কর্মকর্তারা সেটাই বলেছেন।
তবে রিগলি মনে করেন, পরপর কয়েকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফলে প্লেনটির গতিপথ বদলে গিয়ে দুর্ঘটনাও হতে পারে। তিনি হেলিওস এয়ারওয়েজ ফাইট ৫২২-র দৃষ্টান্ত টেনে বলেন, ২০০৫-এ গৃসের একটি পাহাড়ে এই প্লেনটি ক্র্যাশ করেছিল। তার আগে কোনো কারণে ক্যাবিন প্রেশার কমে গিয়েছিল এবং অক্সিজেনের অভাবে প্লেনের ক্রুরা অজ্ঞান হয়ে যান। প্লেন তখন অটো পাইলটে চলতে থাকে এবং পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লাগায়। যদি ওই পেস্ননটা পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা না লাগাত তাহলে তেল ফুরিয়ে না পর্যন্ত্ম উড়তেই থাকত। আমি বলছি না যে এমএইচ৩৭০-এ তেমন কিছু ঘটেছে। তবে এটাও একটা সম্ভাবনা। পাইলটরা বলেছেন, ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনে প্রথম যেসব করতে হয় তার মধ্যে রয়েছে এয়ার ট্রাফিক কনট্রোলে বিপদ সংকেত পাঠান। তবে কোনো দুর্ঘটনায় যদি একই সময়ে সব কমিউনিকেশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে এমন বিপদ ঘটতেও পারে।
৫. ট্রান্সপনডার সিগনাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে কোনো একশন নেয়া হয়নি কেন?
প্লেনের ট্রান্সপনডার মাটিতে অবস্থিত রেডার বা গ্রাউন্ড কনট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ওড়ে। এমএইচ৩৭০-এর ট্রান্সপনডার বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সাউথ চায়না সাগরের ওপর মালয়শিয়ার আকাশসীমা পেরনোর পর পরই এবং ভিয়েতনাম আকাশসীমা ঢোকার আগ মুহূর্তে ট্রান্সপনডার বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ব্যারি বলেন, ইওরোপে এভাবে একটা প্লেন অদৃশ্য হয়ে গেলে এয়ার ট্রাফিক কনট্রোলর কেউ এটা লক্ষ্য করতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিপদ বার্তা দিতেন। গ্র্যাটন একমত হয়ে বলেন, এক আকাশসীমা থেকে আরেক আকাশসীমায় উড়ন্ত প্লেনকে হ্যান্ডওভার করা বা ঝুকিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াটি খুবই স্মার্ট। প্লেন তাদের সীমানার মধ্যে থাকার সময়ে গ্রাউন্ড কনট্রোলাররা সার্বক্ষণিক সরাসরি যোগাযোগ রাখেন। তারা নিশ্চিত করেন অন্য কোনো প্লেন যেন খুব কাছে এসে না পড়ে।
তবে বৃটিশ এয়ারওয়েজের বোয়িং৭৭৭ পেস্ননের সাবেক পাইলট স্টিভ বাজডিগান বলেন, ভিয়েত্নামিজ আকাশসীমায় ঢোকার আগে পেস্ননের ভিএইচএফ ট্রান্সমিশন ১০ মিনিটের জন্য অকার্যকর থাকতে পারে। লিয়ারমাউন্ট বলেন, এটা সম্ভব যে মাটিতে কেউ লক্ষ্য করেননি প্লেনটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। মালয়েশিয়ান এয়ার ট্রাফিক কনট্রোল হয়ত এমএইচ১৭০-কে ভিয়েতনামিজ এয়ার ট্রাফিক কনট্রোলকে বুঝিয়ে দেয়ার পরে বিষয়টি ভুলে গিয়েছিল। ভিয়েতনামিজ গ্রাউন্ড কনট্রোলের সঙ্গে প্লেনটি যে যোগাযোগ স্থাপন করেনি সেটা বুঝতেই পাচ মিনিট লেগে যেতে পারে। তাই কেউ এলার্ম বাটন টেপেনি।
৬. মিলিটারি স্যাটেলাইট দিয়ে মিসিং প্লেন ট্র্যাক করা সহজ নয় কেন?
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরের ১,৫০০ মাইল (২,৫০০ কি.মি) দক্ষিণ পশ্চিমে সমুদ্রে ভাসমান কিছু পদার্থের ভিত্তিতে সন্ধান কাজ চলছে। এই বস্তুগুলোর ছবি সরবাহ করেছে কমার্শিয়াল স্যাটেলাইট কম্পানিগুলো। জিওস্পেশিয়াল ইনসাইট-এর চিফ টেকনলজি অফিসার ড্যান শ্লার বলেন, এ ধরনের ফটো তোলার ক্ষমতা জানা মতে ২০টি স্যাটেলাইটের আছে। এদের মধ্যে সম্ভবত ১০টি স্যাটেলাইট রোজই নিয়মমাফিক ফটো তোলে। ফটোগুলো তারা মাটিতে বিম করে পাঠায়। গ্রাউন্ড রিসার্চ তখন এসব ফটো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে। এতে সময় লাগে।
মিলিটারি এবং সরকারি স্যাটেলাইটও আছে। কিন্তু এমএইচ৩৭০-এর খোজে এদের সামনে দেখা যায়নি। তাই কেউ কেউ বলেন, সার্চের প্রথম দিকেই হয়তো পেস্ননের দুর্ভাগ্যের বিষয়টি জানা গিয়েছিল — কিন্তু সেটা প্রকাশ করা হয়নি। ফাইট ২৩২: ‘এ স্টোরি অফ ডিজাস্টার অ্যান্ড সারভাইভাল’ বইটির লেখক লরেন্স গনজালেস বলেন, ‘কিছু দেশের নিশ্চয়ই খুবই আধুনিক ও উন্নত ও শক্তিশালী সারভেইলাস সিসটেম আছে। কিন্তু সেটা তারা বলছে না। তারা যদি একটা দ্রম্নত ধাবমান ছোট মিসাইলকে লক্ষ্য রাখতে পারে তাহলে সেই তুলনায় ধীর গতিতে উড়ন্ত্ম এক বিরাট জাম্বো জেটকে দেখতে পেল না — সেটা হয় কি করে? সুতরাং কোনো শক্তিশালী দেশ বা গোষ্ঠি জানে প্লেনটা কোথায়। কিন্তু সে বিষয়ে তারা বলতে চায় না। হয়তো এর সঙ্গে তাদের নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত। স্যাটেলাইট টেকনলজি এখন এত উন্নত যে, মহাকাশ থেকেও মাটিতে একটা গলফ বলের ওপরে লেবেলটাও পড়া সম্ভব।’ কিন্তু গ্লাটন বলেছেন, মিলিটারি স্যাটেলাইট নিয়োজিত হয় মিসাইলের ওপর নজর রাখতে। তারা কমার্শিয়াল এয়ারলাইনের ওপর নজর রেখে ডেটাবেইস বড় করতে চায় না। এমএইচ৩৭০-এর তুলনায় মিসাইলের স্পিড চার অথবা পাচ গুণ বেশি এবং সেটা ৩০ থেকে ৫০ মাইল ওপরে চলে। কমার্শিয়াল এয়ারলাইন একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
৭. তেল ফুরিয়ে যাওয়ার পর পেস্ননটা কি গ্লাইড করে সমুদ্রে নেমেছিল? নাকি সরাসরি ডুবে গিয়েছিল? এমএইচ৩৭০-এর শেষ মুহূর্তগুলো কেমন ছিল সেটা নির্ভর করছে সেটার কনট্রোলে তখনো পাইলট ছিলেন কিনা তার ওপরে। গ্র্যাটন বলেছেন, প্লেন আন্ডার কনট্রোলে থাকলে, তাকে গ্লাইড করে সমুদ্রে নামানো সম্ভব ছিল। নিউ ইয়র্কের হাডসন নদীতে একটা এয়ারবাস নামাতে বাধ্য হয়েছিলেন পাইলট। ওই প্লেনের দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে গিয়েছিল। ফলে তেল ফুরিয়ে গেলে যে সমস্যা হতে পারে ওই এয়ারবাসের সেই একই সমস্যা হয়েছিল। ব্যারি একমত হয়ে বলেন, তেল ফুরিয়ে গেলে এই সাইজের একটা প্লেন গ্লাসাইড করে ৫০ মাইল যেতে পারে। তারপর সেটা সমুদ্রে পড়বে। কিন্তু ককপিটের কনট্রোলে যদি কোনো পাইলট না থাকেন তাহলে পেস্নন ধপাস করে পড়ে যেতে পারে।
৮. যাত্রীরা কি জেনেছিলেন প্লেনে সমস্যা হয়েছে? পেস্ননের ক্যাবিনে কোনো বড় রকমের সমস্যা দেখা না গেলে যাত্রীরা জানবেন না ককপিটে কি হচ্ছে। বিশেষত যদি পেস্ননের মধ্যে কোনো মারামারি না হয়। পপুলার মেকানিক্স ম্যাগাজিনের সিনিয়র এডিটর জো পাপালারডো বলেন, প্লেন যখন তার নির্ধারিত গতিপথের বাইরে চলে যায় তখন সাধারণত যাত্রীরা সেটা জানেন না অথবা বোঝেন না। এমএইচ৩৭০-এর যাত্রীদের মধ্যে বেশির ভাগই হয়তো রাত একটায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তবে সচেতন কোনো যাত্রী ভোরে উঠে হয়তো বুঝতে পারেন সূর্যের অবস’ানটি প্রত্যাশিত স্থানে নয়।
মালয়শিয়ান কর্তৃপক্ষ বলেছে, প্লেন ৪৫,০০০ ফিট উচুতে উঠে গিয়েছিল। তারপর ২৩,০০০ ফিট নিচে নেমে এসে গতিপথ বদলেছিল। সে ক্ষেত্রে কিছু যাত্রী হয়তো উচ্চতা কমে আসাটা শারীরিকভাবে টের পেয়েছিলেন। আরেকটা থিওরি হচ্ছে প্লেনকে ইচ্ছা করে ওপরে ওঠানো হয়েছিল হাইপোক্সিয়া (Hypoxia) ঘটানোর জন্য। অর্থাত্, অক্সিজেনের অভাব সৃষ্টির জন্য। সেটা হয়ে থাকলে যাত্রীরা হয়তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন — এমনকি মরেও গিয়েছিলেন। রিগলি বলেন, আকাশে বেশি উচুতে ওঠার সময়ে ক্যাবিনে ডিকমপ্রেশন হলে, অক্সিজেন মাস্ক তাদের সামনে ঝুলে পড়ার কথা। তাহলে তখন তারা বুঝতে পেরেছিলেন কোনো কারণে অক্সিজেন কমে গেছে। তবে এটাও হতে পারে যে সমুদ্রে আছড়ে পড়ার আগ পর্যন্ত্ম তারা কিছুই বুঝতে পারেননি।
৯. যাত্রীরা কেন তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করেননি? পেস্ননে সমস্যা হয়েছে এমনটা বোঝার পরেও কোনো যাত্রীই কেন তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করেননি? তারা তো আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিপদের কথা জানাতে পারতেন। নাইন-ইলেভেনে আমেরিকায় ইউনাটেড এয়ারওয়েজের ফাইট ৯৩ হাইজ্যাক হওয়ার পর কিছু যাত্রী তাদের মোবাইলে গ্রাউন্ডে স্বজনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্‘ এমএইচ৩৭০ প্রায় সাত মাইল উচ্চতায় উড়ছিল। তার গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ মাইল সেখান থেকে কোনো মোবাইল ফোনে যোগাযোগ সম্ভব ছিল না। মাটিতে কোনো সিগনাল পাওয়া সম্ভব ছিল না।
১০. স্যাটেলাইটে সার্বক্ষণিকভাবে সব ডেটা পৌছে দেয়ার যন্ত্র কেন প্লেন ফিট করা হয় না?
বর্তমান যুগে একটা স্মার্টফোন (আইফোন অথবা স্যামসাং গ্যালাক্সি) হারিয়ে গেলে খুজে পাওয়া সম্ভব। সেই তুলনায় একটা অতিকায় জাম্বো জেট প্লেন দু-একটি সিসটেম সুইচ অফ করে এত সহজে কিভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে? ব্যারি বলেছেন, এখন প্লেনের অবস্থানগত ফটো বিভিন্ন সময়ে নেয়া হয়। অনেকটা স্ন্যাপশট ফটো তোলার মতো। কিন্‘ ভিডিও ফটোগ্রাফির মতো চলমান ফটো তোলাও সম্ভব। সার্বক্ষণিক ভিডিও ফটোও তোলা সম্ভব। বোয়িং৭৭৭ সার্ভিসে প্রথম এসেছিল নব্বই দশকের শুরুতে। ওই প্লেনের টেকনলজি সেই যুগের। তবে গ্র্যাটন বলেছেন, একার্স (অঈঅজঝ) সুইচ অফ না করা হলে এমএইচ৩৭০-কে ট্র্যাক করা যেত। এ ঘটনার পর এভিয়েশন ইনডেস্টৃকে বুঝতে হবে প্রতিটি প্লেনে এমন সিস্টেম বসাতে হবে, যেটা ম্যানুয়ালি সুইচ অফ করা সম্ভব নয়। প্রতিটি প্লেনে এমন সিস্টেম থাকতে হবে, যা দিয়ে স্যাটেলাইট থেকে সার্বক্ষণিকভাবে প্লেন দেখা যাবে — এমনকি ককপিটের কথাও শোনা যাবে। কিন্‘ সে ক্ষেত্রে আড়ি পেতে শোনার অভিযোগ উঠতে পারে। প্রশ্ন তখন হবে, কোনটা বড় ঝুকি? প্লেন নিখোজ হয়ে যাওয়া? নাকি ইলেকট্রনিকস আড়ি পেতে শোনা?
২৭ মার্চ ২০১৪
facebook.com/ shafik rehman presents
Posted ১৫:৪০ | বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin