| বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ | প্রিন্ট
ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠী দায়ী। এদের অনৈতিক চাপে ভালো ব্যাংকাররা অস্বস্তিতে থাকেন। তবে এমন কিছু ব্যাংকারও আছেন যারা প্রভাবশালীদের সহযোগী। অন্যায় দুর্নীতির সঙ্গে যোগসাজশকারী এসব ব্যাংকারদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাংকের এমডিদের ‘উন্নয়ন প্রচার আলোচনা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন পর্যবেক্ষক মহল। তারা বলছেন, এটি কি তারা নিজেরা করেছেন, নাকি কেউ করতে বাধ্য করছেন সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রসঙ্গত, গেল সপ্তাহে ব্যাংক এমডিদের নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান সরকারের গত ১০ বছরে ব্যাংকিং সেক্টরের ব্যাপক সাফল্য ও উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। যদিও বাস্তবতা হল, দীর্ঘদিন থেকে ব্যাংকিং সেক্টর নানা সংকটে নিমজ্জিত।
অন্যতম কারণ, বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ ও ঋণ অবলোপনের নামে দেড় লক্ষাধিক কোটি টাকা বাকির খাতায়। ব্যাংকের পরিচালকরাও ভাগাভাগি করে ঋণের বড় অংশ তুলে নিয়েছেন। এমন বাস্তবতায় বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে যুগান্তরের কাছে কয়েকজন বিশ্লেষক তির্যক মন্তব্য করেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকিং একটা পেশা। এ পেশায় রাজনীতি ঢোকানো ঠিক হবে না। এছাড়া মালিক সমিতির সঙ্গে পেশাজীবী সংগঠনের যেন সুবিধাবাদী সম্পর্ক গড়ে না ওঠে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য সব ব্যাংকার বা এমডি দায়ী নন, গুটিকয়েক জড়িত থাকতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়ী চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠী। তাদের কারণে পেশাজীবী ব্যাংকাররা অস্বস্তিতে থাকেন।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি থেকে একজন এমডিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেবে। ডেপুটি গভর্নর মানে তিনি নিয়ন্ত্রক। আর নিয়ন্ত্রক কখনও প্রচারকের ভূমিকায় যেতে পারেন না।
জানা গেছে, ১২ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ। রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলন থেকে দেশের ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মূল্যায়নকে অযৌক্তিক দাবি করেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা।
তাদের দাবি, নিম্নমুখী নয়, বরং গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাত অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো সেবাগুলোর বিস্তৃতির মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। সময় এখন উন্নয়নের জয়গান গাওয়ার। ভাত খেতে গেলে দু-চারটা পড়বেই।
একইভাবে ঋণ বিতরণ করলে কিছু খেলাপি হবেই। খেলাপি ঋণ আছে, থাকবে। তবে সার্বিক বিচারে দেশের ব্যাংকিং খাত ঝুঁকি মোকাবেলা করার সক্ষমতা রাখে। সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকের এমডিরা অভিযোগ করে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গণমাধ্যমসহ বিশিষ্টজনদের একটি অংশ ব্যাংকারদের ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করছে। কিন্তু আমরা সিনেমার ভিলেন হতে চাই না, বরং অর্থনীতির চাকা সচল রাখার মাধ্যমে হিরো হিসেবে বাঁচতে চাই।
এর আগে ৮ ডিসেম্বর সিপিডি দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করে। এতে আর্থিক খাতের বিশিষ্টজনরা দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সিপিডির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, গত দশ বছরে ব্যাংকিং খাতের ১০ কেলেঙ্কারিতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাতে এখন শুধু ভূমিকম্প নয়, বরং আকাশকম্প হচ্ছে। শুধু নিয়ম-নীতির ব্যত্যয় নয়, বরং ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্টরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। আগে এ খাতে সূক্ষ্ম অনিয়ম হলেও এখন তা স্থূল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে উন্নয়নের বদলে অবনতি হয়েছে বলে অনুষ্ঠানে মতামত তুলে ধরেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
সংলাপ অনুষ্ঠানে ফারমার্স ব্যাংকের এমডি এহসান খসরু বলেন, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম শুরু হয় পরিচালনা পর্ষদ থেকে। এমডির কিছু করার থাকে না। চাকরি হারানোর ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে এমডি ম্যানেজড হয়ে যান। একই অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, পর্ষদের কিছুই করার নেই। এমডির অযোগ্যতা এবং অদক্ষতার কারণে এমনটি হয়।
এর দু’দিন পর ১১ ডিসেম্বর সিপিডির মূল্যায়নকে ‘জাস্ট রাবিশ’ বলে উড়িয়ে দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরদিন ১২ ডিসেম্বর গণমাধ্যমের সামনে ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি ‘ভালো’ এমন বার্তা নিয়ে হাজির হন সরকারি-বেসরকারি ৩৭টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি)।
অনুষ্ঠানে অন্তত এক ডজন এমডি দেশের ব্যাংকিং খাতের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তবে প্রশ্নোত্তর পর্বে সংবাদকর্মীদের অনেক প্রশ্নের উত্তরই ব্যাংক এমডিরা দিতে পারেননি। কিছু প্রশ্নের জবাব দায়সারাভাবে দেয়া হয়। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর কৌশলে এড়িয়ে গেছেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের এমডিরা শুধু সমালোচনার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের বাস্তব চিত্রের কথা স্বীকার করে উত্তরণের কোনো পথ খোঁজেননি। এটি ভালো লক্ষণ নয়।
অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক একজন এমডি যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের মাসে হঠাৎ ব্যাংকের এমডিদের উন্নয়ন প্রচার নজিরবিহীন। এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক একজন এমডি যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে এর আগে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের এ ধরনের সংবাদ সম্মেলন কখনও দেখিনি। এটা মূলত বিভিন্ন সেলিব্রেটির (চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা-গায়ক-গায়িকা এবং ক্রিকেটার) নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেয়ার মতো। তিনি আরও বলেন, আগে এবিবির বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত এমডিদের দেখা যেত না। কিন্তু ওইদিনের সংবাদ সম্মেলনে তারাও ছিলেন।
Posted ০৭:১৬ | বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Mahbub