| সোমবার, ৩১ মার্চ ২০১৪ | প্রিন্ট
সাবেক সাংসদ গোলাম মাওলা রনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন,
রাতটা যে ভাল হবে না তা আগেই বুঝেছিলাম। খুবই ছোট একটি মশকরা করতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আর একটু হলেই খটর মটর লেগে যেতো। তিনি তখন সাজগোজ করছিলেন বিয়ে বাড়ীতে যাবার জন্য।
সন্ধ্যার পর দুটি বিয়েতে দাওয়াত ছিলো। একটি হলো দেশের নামকরা ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল মিন্টুর ছেলের বৌভাত। অন্যটি বিএনপি নেতা ব্যারিষ্টার সাইফুর রহমানের ছোটবোনের বিয়ে। একটি হবে বঙ্গবন্ধু কনভেশন সেন্টারে আর অন্যটি হবে নৌবাহিনীর সদর দপ্তরের মধ্যে অবস্থিত সাগরিকা হলে। ইদানীং কেনো জানি আমার সামাজিক ব্যস্ততা বেড়ে গেছে।
লেকজন আমাকে হররোজ দাওয়াত করে। কখনো বিয়ে, কখনো ঘরোয়া আড্ডা কিংবা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। এর বাইরে সভা, সমিতি, সেমিনার, ওয়াজ মাহফিল, দূতাবাসগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও সুন্নতে খাত্না, জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকীতো রয়েছেই। ফলে আমার ব্যস্ততা নিত্য দিনকার। আমি যথাসম্ভব সব জায়গাতে যাই এবং সেজেগুজে যাই-নিজেও সাজি, বউকে সাজাই। মিন্টু ভাই ও সাইফুর ৩/৪ বার ফোন করে আবদার জানিয়েছিলো তাদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। তাই সেদিন একটু ভালভাবে সাজছিলাম। ইদানিং আমি নিয়মিত ঘেডির ব্যায়াম করি। ঘেডি মানে ঘাড়।
ঘাড় এবং থুতনীর নীচে যেনো চর্বি না জমে সে ব্যাপারে কঠোর পরিশ্রম করছি হররোজ। স্ত্রী যখন সাজছিলেন তখন মনে হলো তার থুতনীর নীচে কিছু চর্বির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। বেকুবের মতো সে কথা বলে তাকে যেই না জ্ঞান দিতে শুরু করেছি তখনই বুঝলাম-সর্বনাশ করে ফেলেছি। কারো ঘেডিতে চর্বি জমলে- সেকথা বলতে নিষেধ- তা আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ৩০ বছরের পুরোনো সংসার- কোনমতে ম্যানেজ করে তড়িঘড়ি রওয়ানা হলাম।
প্রথমে গেলাম মিন্টু ভাইয়ের দাওয়াতে। এলাহী ব্যাপার স্যাপার। কি নেই সেখানে-উজির নাজির, সাহেব, গোলাম থেকে শুরু করে সমাজের সকল শ্রেণীর এবং সূযোগ্য সকল শ্রেণী পেশার লোকজন কিংবা যোগ্য প্রতিনিধি। সাথে দই মিষ্টি- মুরগী, ফিরনি, কালিয়া, কোপ্তা থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু। সবার সঙ্গেই আমার ভাব- অভিজাত নারী পুরুষগণ চমৎকার সব পোশাক আশাকে পুরো অনুষ্ঠানকে বর্ণময় করে তুলছেন। ইচ্ছা হচ্ছিলো আরো কিছুক্ষণ থাকি।
কিন্তু দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য আমরা তাড়াহুড়ো করতে থাকলাম। আমি নিজেও খুব কম খেলাম এবং স্ত্রীকেও বাধ্য করলাম কম খেতে। কারণ দ্বিতীয়টিতে গিয়ে মজা করে খেতে হবে। ২৮ মার্চ রাত ৯.১৫ মিনিটের দিকে আমরা বঙ্গবন্ধু কনভেশন হল থেকে বের হয়ে সাগরিকা হলের দিকে রওয়ানা হলাম। রাস্তা ফাঁকা থাকার কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৌছে গেলাম। যাওয়ার পথে স্ত্রীকে বললাম-সাইফুর আমার স্নেহের ছোট ভাই।
আমার লেখার দারুণ ভক্ত। দেখবে- ও যদি আমাদেরকে পায় তাহলে কিভাবে খুশীতে লাফাতে থাকে! ও নিজের হাতে তোমাকে খাবার পরিবেশন করবে এবং ইচ্ছে না থাকলেও তোমাকে খেতে হবে অনেক। আমার কথা শুনে বেগম সাহেবা কেনো জানি চোখ দুটো গোল গোল করে মায়াবী হরিণীর মতো আমার দিকে তাকালেন। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলাম। তিনিও কেনো জানি ঢক্ঢক্ করে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিলেন।
আমাদের গাড়ী নৌবাহিনীর সদর দপ্তরের পেছনের গেটের সামনে পৌছালো। এই গেট দিয়েই সাগরিকা হলে হলে ঢুকতে হয়। আমি ইতিপূর্বে কয়েকবার এখানে এসেছি এমপি থাকাকালীন অবস্থায়। বেশ ফাটাফাটি অবস্থা। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা দৌড়ে আসতো। স্যার বলে স্যালুট দিতো এবং বিনয়ের সঙ্গে গেট খুলে দিতো। এমপি হবার পূর্বেও গিয়েছি। সকল বিনয় ও ভদ্রতা প্রায় একই রকম কেবল স্যালুট ছাড়া। কিন্তু ঘটনার রাতে ঘটলো ব্যতিক্রমধর্মী এক দূর্ঘটনা। মনে হয়েছিলো, তারা বোধহয় সন্ধ্যা থেকে আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে কিছু একটা শিক্ষা দেবার জন্য তারা শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলেন।
আমাদের গাড়ি গেটে পৌঁছা মাত্র তারা প্রথমে মনে করলো হয়তো কোন এমপির গাড়ি। হন্ত দন্ত হয়ে চলে এলো। এরপর গাড়িতে কোন স্টিকার না দেখে গাড়ির গ্লাসে জোরে জোরে থাপ্পর দিলো তা খোলার জন্য। লেক্সাস জীপ-সেন্ট্রাল লক করা। আমার স্ত্রী বার বার চেষ্টা করা সত্ত্বেও খুলতে পারছিল না। বোকা ড্রাইভার নৌবাহিনীর সেদিনের দায়িত্বরত গেটের কর্মকর্তাদের এহেন আচরনে হত চকিত হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। সে তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে উল্টাপাল্টা সুইচে চাপ দিলো। ফলে গ্লাস খুলতে আরো ১০/১২ সেকেন্ড দেরী হয়ে গেলো। কর্মকর্তাগণ আরো জোরে গাড়িতে থাপ্পড় মারতে লাগলেন।
আমি নিজে যারপর নাই বিস্মিত হলাম। ১৯৯৮ সাল থেকে লেক্সাস জীপ চালাচ্ছি। এই গাড়ি নিয়ে গেলে সবাই একটু যত আত্মি করে। আজ কেনো উল্টো হচ্ছে! এর মধ্যে গ্লাস খুলে গেলো। অফিসারগণ জিজ্ঞাসা করলেন- আপনারা কারা? আমি বললাম। তারা ব্যঙ্গ করে বললো- তা ভাই কি সাবেক এমপি। আমি উত্তর করলামÑ জ্বী স্যার। তা পাশে বসা উনি কে? বিনয়ের সঙ্গে বললাম- স্ত্রী। তারা হুকুম করলেন গাড়ি সরিয়ে ঐ পাশে সাইট করে রাখুন। একটু সমস্যা আছে- উপরে যোগাযোগ করতে হবে।
নিতান্ত বাধ্যগত বালকের মতো গাড়ি সাইট করে বসে রইলাম। দশ মিনিটÑ বিশ মিনিট- শেষ পর্যন্ত আধা ঘন্টা। আমাদের পাশে সাদা রংয়ের আরো একটি জীপে ৬/৭ জন আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। তারা এতোক্ষন মুখ ভার করে বসে ছিলেন। আমাদের গাড়ি তাদের পাশে থামাতেই তারা গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে আমাকে দেখলেন। বড়ই আনন্দ পেলেন এবং উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। আমার তখন কেমন যেনো বমি বমি ভাব আসছিলো। কিন্তু শরম-লজ্জা ও দ্বিধার কারণে বমি করতে পারছিলাম না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো- গাড়িতে বসা মেহমানদের পরিচয় এবং এও জানতে ইচ্ছে হচ্ছিলো- কেনো তারা আমার দুরাবস্থা দেখে হাসছিলেন।
কিছুক্ষণ পর সাদা গাড়ির আরোহীদেরকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হলো। আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। আধাঘন্টা পর আমার ড্রাইভারকে পাাঠালাম জিজ্ঞাসা করার জন্য-আমরা কি অপেক্ষা করবো না চলে যাবো? তারা ড্রাইভারকে তাদের রুমে ৬/৭ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখলো। আমি উৎকন্ঠিত হয়ে গাড়ির ভিতর বসে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম।
এরপর ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে একজন ইউনিফর্ম পরা কর্মকর্তা আসলেন। সম্ভবত হাতে লাঠি ছিলো কি ছিলোনা তা মনে করতে পারছিনা। আমি একথাও মনে করতে পারছিনা তিনি গাড়ির সামনে এসে লাঠি দিয়ে টুক টুক আওয়াজ করে গ্লাস খুলতে বলছিলেন নাকি পূর্বের মতো কঠিন হাতে গ্লাসে থাপ্পড় মেরে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আমি গাড়ির গ্লাস খুললে কর্মকর্তাটি বললেন- আপনাকে চলে যেতে হবে। আপনি ঢুকতে পারবেন না এখানে। আমি ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, কেনো? আপনার ব্যাপারে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স নেই। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম- আচ্ছা এই সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স কারা দেন? তিনি ধমকের স্বরে বললেন, এতো কিছু জানেন আর এটা জানেন না!
কথা না বাড়িয়ে আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলাম। পথিমধ্যে আওয়ামী লীগের এক বড় নেতো ফোন করলেন। তিনি ঘটনা শুনে বড়ই বিস্মত হয়ে বললেন- আমাদের রনি ইদানিং বড় মানুষ হয়েছে জানতাম কিন্তু এতটা বড় হয়েছে তা তো জানতাম না। আমি পাশ ফিরে স্ত্রীর দিকে তাকালাম। আশ্চর্য এবার লক্ষ্য করলাম তার ঘেডিতে একটুও চর্বি নেই।
Posted ১৩:৩৫ | সোমবার, ৩১ মার্চ ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin