| শুক্রবার, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট
সময়ের সাথে তালমিলিয়ে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নামও অর্ন্তভূক্ত হয়েছে।কিন্তু সত্যিকার অর্থে কি বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে?যদিও দেশের কিছু কিছু লোকের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়ে থাকে তাও তাদের কঠোর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর আর নিজের শরীর থেকে রক্ত ঝড়ানো পরিশ্রমের ফলে সামান্য পরিবর্তন হয়েছে।
আমাদের অনেক লোক তাদের জীবন যাত্রার মান্নোয়নের জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়ে থাকে।কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তাদের অবস্থা কি হয়? কিভাবে কাটে তাদের জীবন? কিভাবে রোজগার করেন টাকা-পয়সা? সে খবর কি কেউ কোন দিন নেয়? নেয় না।যদিও নিয়ে থাকে পরিবার থেকে তাও শুধু টাকা-পয়সা পাওয়ার জন্য নিয়ে থাকে।একজন লোক বিদেশ যাওয়ার পর তার পরিবার হতে নিয়মিত ফোন করে শুধু টাকা-পয়সা চায়।কিন্তু কিভাবে টাকা-পয়সা দিবে সেটা পরিবার হতে কোন সময়ই জানতে চাওয়া হয়নি।আর চাইবেই বা কেমন করে,কারন যারা বিদেশ যায় তাদের মধ্যে শতকরা ৯০জন লোক দেশের বিভিন্ন লোকজন হতে অথবা কোন ব্যাংক বা এনজিও হতে সুদে টাকা নিয়ে বিদেশ যায়।এই পাওনাদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো মাস শেষ হতে না হতেই বাড়িতে গিয়ে বসে থাকে তাদের সুদের টাকার জন্য।সময়মতো সুদের টাকা দিতে না পারলে বাড়ির লোকজনদের কে শুনতে হয় কটু কথা,সহ্য করতে হয় মানসিক নির্যাতনসহ আরও অন্যান্য ঝামেলা।
তখন বাড়ির লোকজন রাগে ক্ষোভে বিদেশী লোকের কাছে দেশের চলমান সমস্যার কথা ও অনেক সময় গালিগালাজ পর্যন্ত করে থাকে।এসব কথা শোনার পর বিদেশের বাড়িতে গভীর চিন্তা-ভাবনার মধ্যে পড়ে যায়,সেখানে তাদের কে শান্তনা দেওয়ার মতো কোন লোকজন নাই।এদিকে বিদেশের বাড়িতে মালিকের কাজ করার পর অনেক মালিকই মাসের শেষ তাদের বেতনের টাকা নিয়মিত পরিশোধ করে দেয় না।যার জন্য সময়মতো বাড়িতেও টাকা-পয়সা পাঠাতে পারে না।যার জন্য সবসময় তাকে পরিবারের লোকজনের কথা শুনতে হয়।সারাক্ষন শুধু চিন্তায় থাকে।তাছাড়া বিদেশে বাংলাদেশের যেসব দুতাবাস রয়েছে সেখান থেকেও তারা তেমন কোন সাহায্য-সহযোগিতা পায় না বলে অনেক বিদেশ ফেরত লোকজন জানান।বিদেশে যেসমস্ত দুতাবাস রয়েছে তাদের কাজ হলো নিজ দেশের লোকজন যাতে বিদেশে অবস্থানকালে কোন সমস্যায় না পড়ে সে ব্যাপারে তাদের খোঁজখবর নেয়া।
নিজ দেশের লোকজন সে দেশের কোন কোম্পানী বা লোকজনের কাজ করে টাকা-পয়সা না ফেলে নিজদেশের দুতাবাস কে জানানো।দুতাবাস ঐ কোম্পানী বা মালিকের সাথে আলোচনা করে তার ন্যায্য টাকা আদায় করার ব্যবস্থা করা।কিন্তু আমাদের দেশের লোকজন বিশ্বের অনেক দেশে অবস্থান করছে।আমরা নিয়মিত বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখি বিভিন্ন দেশে আমাদের বাংলাদেশের লোকজন কর্মের সন্ধানে গিয়ে সে দেশে নানাহ রকম কষ্টে অবস্থা করছে আবার অনেক বাঙালি বিভিন্ন দেশের জেলখাতে অবস্থান করছে।কিন্তু বাংলাদেশের দুতাবাসগুলোর এ ব্যাপারে তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায়নি।কিন্তু কেন?এমন হবে?যে ভাইদের রক্ত ঝড়ানো টাকায় আজ বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় না লেখালো তাদের প্রতি কেন এত অবহেলা?বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশী লোকজন বিভিন্ন রকম অতিরিক্ত টেনশন,ঠিকমতো খানাখাদ্য,চিকিৎসা,বেতনভাতা ও বসবাসের সমস্যার জন্য তারা রোগাক্রান্ত হয়ে তারা আজ মৃত্যুপথের যাত্রী হয়ে দাঁড়িয়েছে।অনেকে আবার ষ্ট্রোক করে মারা যাচ্ছে।সৌদি আরবের দাম্মামে একটি কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাকির হোসেন।
১৬ জানুয়ারি রাতে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলে হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসারত অবস্থায় ওইদিনই মৃত্যুবরণ করেন এ সৌদি প্রবাসী।৯ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন ইতালি প্রবাসী শাহাদাত হোসেন। পরবর্তী সময়ে মেডিকেল পরীক্ষায় মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয় ‘স্ট্রোক’। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় তার তিন সন্তান রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ইতালির উত্তর-পশ্চিম সালেরনো এলাকায় বসবাস করতেন তিনি।
প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের মৃত্যুর এ হার প্রতি বছরই বাড়ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় ২০১৮ সালে প্রবাসী মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। যদিও এটি দেশে ফেরত আসা বৈধ শ্রমিকের মরদেহের হিসাবমাত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক ও হূদরোগ। এদের অধিকাংশেরই বয়স ২৫-৩৫ বছরের মধ্যে।
অভিবাসন ব্যয়ের তুলনায় কম আয়ের কারণে মানসিক চাপ ও দীর্ঘদিন স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে একাকিত্বই প্রবাসী শ্রমিকদের স্ট্রোক ও হূদরোগের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি দৈনিক ১২-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম, অপর্যাপ্ত খাবার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকার কারণেও রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।
হূদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এপিএম সোহরাবুজ্জামানের মতে, প্রবাসীরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকায় তাদের মধ্যে হূদরোগে আক্রান্তের হার বেশি। এছাড়া দেশের বাইরে যাওয়ার পর তাদের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসে, যা হূদরোগের জন্য দায়ী। আবার অনেকে জানেন না, কোথায় কীভাবে চিকিৎসা নিতে হয়। কোনো ধরনের চেকআপের মধ্যে না থাকায় অনেকে হূদরোগে ভুগলেও চিকিৎসা না করায় হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
সবসময় চাপের মধ্যে থাকায় প্রবাসীদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেশি বলে জানান বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা।প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে মোট ৩ হাজার ৭৯৩ বাংলাদেশী কর্মীর মরদেহ দেশে আনা হয়েছে। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩৮৭। এছাড়া ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭ ও ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫ জন বৈধ কর্মীর মরদেহ দেশে এসেছিল। অধিকাংশের ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে স্ট্রোক ও হূদরোগ।
২০১৮ সালে ৩ হাজার ৬৭৬ জন বৈধ কর্মীর পাশাপাশি অবৈধভাবে কর্মরত ১১৭ জনের মরদেহও দেশে এসেছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৫৩টি মরদেহ এসেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এছাড়া ৩৭৪টি মরদেহ এসেছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ৬৬টি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বেশির ভাগ মরদেহই এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে সৌদি আরব থেকে। সৌদি আরবের পর বেশি মরদেহ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে।
সুস্থ দেহে দেশ থেকে যাওয়ার পরও প্রবাসী শ্রমিকদের স্ট্রোক ও হূদরোগে মৃত্যু কেন বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত। কারন প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশে পাড়ি দেয়ার আগে মেডিকেল চেকআপ করে যাচ্ছেন। সে সময় কিন্তু হূদরোগ ধরা পড়ছে না। বিদেশে পৌঁছার পরও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় এ ধরনের কোনো উপসর্গ পাওয়া যাচ্ছে না। এর পরও প্রবাসী শ্রমিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যু কেন বাড়ছে, সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। আর যেসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে দুর্ঘটনা বা অন্যান্য রোগের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কতটা ঠিক, তাও বিবেচনা করতে হবে। কারণ বিমানবন্দরে মরদেহ আসার পর স্বজনরা প্রকৃত কারণ খোঁজার চেয়ে তাড়াতাড়ি দাফনেই বেশি গুরুত্ব দেন।
বেশি ব্যয়ে বিদেশে গিয়ে প্রত্যাশিত আয় করতে না পারার কারণেও মানসিক চাপে থাকছেন অনেকে। অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিকই দালালের প্রলোভনে বেশি ব্যয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে বেশির ভাগ সময়ই তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন না, যা তাদের সবসময় মানসিক চাপের মধ্যে রাখছে। আকস্মিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ এটি। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ, যেমন প্রবাসী ভারতীয় ও নেপালের নাগরিকদের আকস্মিক মৃত্যুর হার কম। কারণ সেসব দেশের অভিবাসন ব্যয় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম।
দালালের প্রলোভনে না পড়ে দক্ষতা নিয়ে বিদেশে গেলে ভালো বেতনের চাকরির নিশ্চয়তা থাকে। এ বিষয়ে বিদেশ গমনেচ্ছুদের সচেতন করতে মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
প্রবাসে মারা যাওয়া শ্রমিকদের মরদেহ দেশে আনতে সহযোগিতা করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে দাফনের জন্য বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড প্রথমে ৩৫ হাজার ও পরে ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান দেয়। প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী কর্মীদের পরিবারগুলোকে ২০১৮ সালে ১১৮ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে বোর্ড। ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ১০১ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। মরদেহ পরিবার কে টাকা দিলে সমস্যার সুরাহা হবে না।বিষয়টির প্রতি দেশের উবর্ধতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে দেশের সচেতন মহল মনে করেন।
লেখক : সাবাদিক ও কলামিষ্ট
Email-ganipress@yahoo.com
Posted ০৭:৫৮ | শুক্রবার, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin