রবিবার ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরিবেশ বিপর্যয়রোধে তরুণদের কর্তব্য

  |   বুধবার, ০৫ মার্চ ২০১৪ | প্রিন্ট

ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুল আউয়াল

abdul awalপরিবেশের সাধারণ সংজ্ঞা হচ্ছে-আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে এ সব নিয়ে আমাদের পরিবেশ। আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা এসব আমাদের পরিবেশের অর্ন্তভুক্ত। আল্ কুরআনের ভাষায় পরিবেশের সংজ্ঞা হচ্ছে : তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও না কেন, সেদিকই আল্লাহর দিক। (সূরা বাকারা : ১১৫) পরিবেশে জীবের বাসোপযোগী গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি ও মাটি। মূলত মাটি থেকেই অনেক কিছু উৎপন্ন হয় এবং উৎপাদিত শস্য পানি দ্বারা জীবিত থাকে।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপন্ন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝর্নাধারা, যাতে তারা ফল খায়।’ (সূরা ইয়াসিন : ৩৩) অন্য আয়াতে  বলা হয়েছে, ‘যে পবিত্র সত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা ও আকাশকে ছাদরূপে স্থাপন করেছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপন্ন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না। বস্তুত তোমরা এসব জানো।” (সূরা বাকারা : ২২)।
পবিত্র কোরআনের এ আয়াত দ্বারা পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা অবগত হই। মানুষ মহান আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির সেরা জীব। আঠার হাজার মাখলুকাতের মধ্যে মানুষকে আল্লাহ তায়ালা শ্রেষ্ঠত্বতা দান করেছেন। পৃথিবীতে তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সব মানুষের কল্যানের জন্য। তাই সর্ব শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু আমরা সে দায়িত্ব কতটুকু পালন করছি। এই পৃথিবীতে মানুষ টিকে থাকতে হলে, সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশের গ্যারান্টি নিজেদেরকেই দিতে হবে। আমাদের ভৌগোলিক পরিবেশ রক্ষায় প্রতিটি মানুষকে নিজ উদ্যোগে সচেতন হতে হবে। তা না হলে পরিবেশ দিন দিন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
সুইডেনের স্টকহোমে ৭ দিন ব্যাপী World Water Week-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে বক্তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই বলে যে, “আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা যখন আরো ৩০০ কোটির মতো বেড়ে যাবে তখন পানি সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’ জীবন ধারণের জন্য পানির কি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সকলেই অবগত। পানি সঙ্কট মানেই পরিবেশের ওপর মারাত্মক হুমকি। সর্বকালের অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বিশ্ব পরিবেশ দিবস (২০০৬)-এর ভাবনা হিসেবে Yahoo web site ব্যবহারকারীদের প্রতি প্রশ্ন রাখেন, ‘রাজনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ এ পৃথিবীকে আরো ১০০ বছর টিকে থাকার জন্য মানুষকে কোন্ উপায় অবলম্বন করতে হবে?’ গত ১০-১-২০০১ মুম্বাইতে The universe in a nutshell শীর্ষক এক সেমিনারে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্টিফেন হকিং।
তিনি বলেন, ‘বিশ্ব যে ক্রমশ উষ্ণ হয়ে পড়ছে, এ ব্যাপারে আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, গ্রিন হাউজ ইফেক্ট হয়তো রোধ করা যাবে না, সেক্ষেত্রে মানবজাতির অস্তিত্ব এক হাজার বছরের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পৃথিবীর আবহাওয়া হয়ে যাবে শুক্র গ্রহের মতো। শুক্র গ্রহে সালফিউরিক এসিড বৃষ্টি ঝরে।’ গ্রিন হাউজ ইফেক্টের বিরুদ্ধ শক্তিশালী জনমত তৈরির আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, এটা করা না গেলে আমরা আর এক হাজার বছরও টিকব না।’
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে সচেতনতা সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন একদল পরিবেশবাদী। আন্তর্জাতিকভাবে নিউজিল্যান্ডের ‘গ্রিনপিস’ অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। দেশে দেশে গবেষণা, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য কিভাবে রক্ষা হবে? বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো শিল্পোন্নত দেশগুলোকে দায়ী করছে।
এক রিপার্টে জানা গেছে, ‘সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর জন্য তৃতীয় বিশ্ব নয়, বরং উন্নত বিশ্বই দায়ী।’অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, পরিবেশ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু সচেতনতা বাড়ালেই চলবে না। যথাযথ আইন-প্রণয়ন ও প্রয়োগের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। সমাজের মানুষকে শৃঙ্খলিত রাখতে আইনের প্রয়োজন। সমাজে আইনের শাসন বিদ্যমান থাকলে সেখানে অপরাধও কম হয়। পরিবেশের ক্ষতি করা একটি জগন্য অপরাধ। পরিবেশ রক্ষায় আইনের যথাযত প্রয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন। সেই সাথে সাথে আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্বের । সে হতে পারে আধুনিক সিংগাপুরের রূপকার মিস্টার লি কুয়ান ইয়ো অথবা আধুনিক মালয়শিয়ার রূপকার আমাদের দেশের পরিবেশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই নানা দূষণের চিত্র। বিশেষ করে পরিবেশকে উপেক্ষা করে যত্রতত্র ইটভাটা র্নিমাণ আমাদের পরিবেশকে মারাত্ত্বক ঝুকির মধ্যে ফেলেছে। ফসলি জমির টপসয়েল ও পাহাড় কেটে ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কচি কচি গাছ কেটে ইট ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে বাশের গোড়া ইটভাটায় পোড়ানোর ফলে বাশ এখন বিলীনের পথে।
পরিবেশ আইন অমান্য করে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আবাদি জমির ওপর যত্রতত্র ইটভাটা স্থাপনের ফলে কালো ধোঁয়ায় মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ ও জনস্বাস্থ্যের সমস্যা বাড়ছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোতে প্রধান জ্বালানি কয়লার সহায়ক জ্বালানি হিসেবে কাঠ, পরিত্যক্ত টায়ার, রাবার ও তেলের গাদ ব্যবহার করে পোড়ানো হচ্ছে ইট। সরকারী বিধান মতে গাছ কেটে ভাটায় জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা নিষেধ থাকলেও অধিকাংশ ইটভাটা এ নিয়ম মানেনা। এসব কার্যকলাপে পরিবেশের বিপর্যয় হচ্ছে মারাতœক ভাবে।
ইটভাটাগুলোর চিমনি দিয়ে অনবরত নির্গত হচ্ছে দূষিত কালো ধোঁয়া। এ দূষিত কালো ধোঁয়ার প্রভাবে আবাদি জমির ফলন কমে যাচ্ছে। এছাড়া দেশীয় ফলের মুকুল ও গুটি ঝরে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে দেখা দিয়েছে সর্দি, কাশি, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, চোখ উঠার মতো নানা রোগ-ব্যাধি। বায়ুদূষণের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৭৮টি দেশের মধ্যে রয়েছে। পরিবেশ ও জীবনমানের ওপর এর কুপ্রভাব বিষয়ে ইয়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যে বৈশ্বিক সূচক প্রকাশ করেছেন তাতে বাংলাদেশ দশম স্থানে রয়েছে।
অপরদিকে গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স ২০১৪-এর এক তথ্য প্রকাশে জানা যায়, বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৬৯তম।
জনস্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাব বায়ুর মান, কৃষি, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র ও বাসস্থান, আবহাওয়া এবং জ্বালানি প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে ১০০ স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ২৫.৬১। শুধু বায়ুদূষণের কথা বিবেচনা করলে বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে মাত্র ১৩.৮৩। এ হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান হবে সবার শেষে অর্থাৎ ১৭৮তম। অপরদিকে ভাটাগুলোতে ইট তৈরির প্রধান উপাদান মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে বিভিন্ন আবাদি জমির উপরি অংশের মাটি টপ সয়েল থেকে। এ কারণে দিন দিন কৃষি জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। ফলে দেখা দিয়েছে উৎপাদন হ্রাস। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে আবাদি জমির সঙ্কট। বিশ্বের মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার মিলিয়ন হেক্টর অর্থাৎ ৩৭ হাজার মিলিয়ন একর। মোট ভূমির ৭৮ শতাংশ চাষাবাদের অনুপযোগী এবং ২২ শতাংশ কার্যকরভাবে চাষযোগ্য। আর আমাদের বাংলাদেশের মোট ভূমির পরিমাণ ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার একর। মোট আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ ২ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার একর। অপরিকল্পিত আবাসন ও যত্রতত্র শিল্পকারখানা স্থাপনের ফলে প্রতি বছর আবাদি জমির পরিমান হ্রাস পাচ্ছে।
শিল্প কারখানার বর্জ্য আমাদের নদীকে অতিমাত্রায় দূষণ করছে। কলকারখানার বর্জে ঢাকার আশপাশের নদীর চিত্র এমন হয়েছে যে নদীর পানিতে এখন হাত দেয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। ঢাকার নদী কতটা দূষিত তা বুড়িগঙ্গার তীরে গেলেই সহজে অনুমান করা যায়। অথচ এই বুড়িগঙ্গার কারনেই আমাদের এই ঢাকা প্রাচীন ভারতবর্ষে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ হয়ে ওঠে। বুড়িগঙ্গা নদীর প্রাচীনত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় বুদ্ধগঙ্গা নামে দুই হাজার বছর আগে রচিত কলিকা পুরাণে।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে যে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ৯ হাজার, কালের সাক্ষী বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের সেই ঢাকার লোকসংখ্যা এখন প্রায় দেড় কোটির মতো। আর আয়তন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২৯ বর্গকিলোমিটার। সময়, আয়তন, ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ন আর মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকা-ের দরুন বুড়িগঙ্গার অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। সচল সজীব আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতীক বুড়িগঙ্গা এখন শ্রীহীন, মৃতপ্রায় বিষাক্ত এক জলাধারা।
বুড়িগঙ্গা নদীর এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী মূলত অবৈধ দখলদারদের অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন আর দূষণকারী একশ্রেণীর অবিবেচক নাগরিক। অবৈধভাবে নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা অসংখ্য শিল্প-কারখানা, বহুতল মার্কেট, ইট-পাথর-সিমেন্টের মহাল, কাঁচামালের আড়ত, ছিন্নমূল মানুষের শত শত বস্তি, নদী ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির কারণে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে নদীর প্রস্থ। সেই সঙ্গে একশ্রেণীর বিবেকহীন মানুষের যথেচ্ছ অপব্যবহারে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দূষণ অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। শিল্প-কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, স্যুয়ারেজের মলমূত্র, দূষিত পানি, গৃহস্থালি, বাণিজ্যিক ও মেডিকেল বর্জ্য, মৃত জীবজন্তু নিক্ষেপ, নৌযানের তেল, মবিল, গ্রিজসহ সব ধরনের তরল ও কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে।
বুড়িগঙ্গা নদীতে জানুয়ারি থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কোন প্রবাহ থাকে না। স্রোত না থাকায় বিষাক্ত বর্জ্য, মরা জীবজন্তু, ময়লা-আবর্জনা, মানুষের মলমূত্র ইত্যাদি পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। একই সঙ্গে এসব বর্জ্য নদীর তলদেশও ভরাট করে দিচ্ছে। পলিথিনসহ কঠিন বর্জ্য জমে নদীর তলদেশ ৩ থেকে ৪ মিটার ওপরের দিকে উঠে গেছে। বিরামহীন অসংখ্য নৌযান চলাচলের কারণে রাসায়নিক বর্জ্য, তেল, আবর্জনা, মলমূত্র আর কাদা মিলেমিশে নদীর পানি ভিন্ন প্রকৃতির এক তরল পদার্থে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। বহন ক্ষমতার অতিরিক্ত বর্জ্যের ভারে কেদাক্ত বুড়িগঙ্গার পানি এখন নোংরা ও কুৎসিৎ। এককালের জীবনদায়িনী সৌন্দর্যময়ী স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গা এখন ঢাকার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণের আরেকটি প্রধান উৎস হচ্ছে হাজারীবাগ ট্যানারি শিল্প এলাকা। এখানকার ১৭০টি ট্যানারিসহ আড়াই শতাধিক শিল্প-কারখানা থেকে প্রতিদিন বিশাল পরিমাণ অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। প্রতিদিন হাজারীবাগ শিল্প এলাকা থেকে ১৫ হাজার ৮০০ ঘনলিটার, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে ৩ হাজার ৫০০ ঘনলিটার এবং অন্যান্য শিল্পাঞ্চল থেকে ২ হাজার ৭০০ ঘনলিটার দূষিত পানিসহ বিষাক্ত রাসায়নিক তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া ট্যানারি থেকে প্রতিদিন ১৯ টন অদ্রবণীয় কঠিন বর্জ্য পদার্থ, পচনশীল লেদার কাটিং, কোশিং লোম, রক্ত, সোডিয়াম সালফেট, ক্রোমিয়াম অক্সাইড, তেল, গ্রিজজাতীয় পদার্থ, অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত পানি এবং ৭.৫ বিওডি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এর সঙ্গে গৃহস্থালির সৃষ্ট প্রায় ৩ হাজার টন আবর্জনা নদীতে ফেলা হচ্ছে। মোটকথা, শিল্পবর্জ্য, ব্যবসায়িক বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য ও মানববর্জ্য মিশে বুড়িগঙ্গার অস্তিত্ব এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এখন মাছসহ সব ধরনের জলজপ্রাণীর জীবন ধারণের পক্ষে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। জলজপ্রাণী বেঁচে থাকার জন্য প্রতি লিটার পানিতে ৬ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু বুড়িগঙ্গার হাজারীবাগে এর পরিমাণ প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রাম, চাঁদনীঘাটে ২ মিলিগ্রাম, সদরঘাটে ১ মিলিগ্রাম, ফরাশগঞ্জে ১.৫ মিলিগ্রাম, ধোলাইখালে ০ মিলিগ্রাম এবং পাগলাতে ১ মিলিগ্রাম। আর এ কারণে হাজারীবাগ থেকে পাগলা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতে কোন মাছ নেই। ট্যানারি কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম ও আর্সেনিকের মাত্রা বুড়িগঙ্গায় দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। প্রতি লিটার পানিতে ক্রোমিয়ামের গ্রহণযোগ্য মাত্রা .০৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু বুড়িগঙ্গার পানিতে এর পরিমাণ ২৪ মিলিগ্রাম। অ্যালুমিনিয়াম রয়েছে ৫ মিলিগ্রামের নিচে, কোডিয়াম ৯ মিলিগ্রাম। চাঁদনীঘাটের কাছে মার্কারি ও কোরাইডের মাত্রা খুবই ভয়াবহ।
বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের মাত্রা এতটাই মারাত্মক যে, এখন তা পরিশোধনেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ট্যানারি শিল্প কারখানার রাসায়নিক ও জৈববর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিকে তো দূষিত করেছেই, সেই সঙ্গে নদীতীরবর্তী এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করে ফেলেছে। বুড়িগঙ্গা দূষিত হয়ে পড়ায় ইতিমধ্যে নগরীতে নানা ধরনের জটিল ও কঠিন রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় গুলোতে বাংলাদেশ আশানুরূপ এগুতে পারেনি এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইমার্জিং টাইগারের খাতায় নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছিল। আজকে অর্থনীতির বিষয়ে কোন কথা নয়। আর এই অর্থনীতি তথা বিনিয়োগ হয়েছে শিল্পায়নের মাধ্যমে। তবে বলা বাহুল্য এই শিল্পায়ন হয়েছে অপরিকল্পিত। শিল্প উদ্যেক্তারা যেমন বেখেয়ালীর বশবর্তী বা পরিবেশের কথা চিন্তা না করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তেমনি সরকারের পরিবেশ মন্ত্রনালয় পরিবেশ সংরক্ষনের নামে অর্থনৈতিক জোন অনৈতিকভাবেই গড়ে তুলেছেন।
যার ফলে এই সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষিত বর্জ্য খাল হয়ে নদীতে অথবা সরাসরি নদীতে ফেলছে। দেখার যেন কেউ নেই। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রসপেক্টাস এ একরকম আর কার্যফল আরেক রকম। এদের কার্যকারন বিশ্লেষন করলে মনে হয়- একটি উন্নয়ন দিয়ে ১০ টি খাতে অনুন্নয়ন। তাদের এ বিনিয়োগে অবশ্যই কর্মসংস্থান হচ্ছে। তা হয়তো লাখ খানেক ব্যক্তির। কিন্তু তাদের এই লাখ খানেক মানুষের অপরিকল্পিত শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কার্যক্রম এদেশের নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস করে দিচ্ছে। খালগুলো ভরাট করে ফেলছে। নদীতে অস্বাভাবিক মাত্রায় পলি দিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ অনেকটা অজ্ঞান অবস্থায় আছেন।
যদিও সরকার ইতোমধ্যে ই টি পি প্লান্ট করার জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলোকে চাপ প্রদান করেছে। কিন্তু উদ্যেক্তারা তাদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে চলেছেন- এটি অনেক ব্যয় বহুল। কিন্তু কথা হল- প্রতিষ্ঠানের বায়াররা যদি বলে যে এটা বা ওটা ছাড়া তোমার পন্য কিনব না। তখন কিন্তু ব্যবসায়ীরা তড়িঘড়ি করে তাদের দাবী পূরন করে। কিন্তু দেশের খেয়ে পড়ে- এদেশের নদীগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য গুলো।
একদিকে উদ্যোক্তাদের আগ্রহের অভাব, আরেকদিকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে- নদীবিধৌত বাংলাদেশ বর্জবিধৌত হতে চলেছে। আর এর মাধ্যমে যে সকল সমস্যা তৈরী হচ্ছে তা ভোগ করছে সাধারন মানুষ। আজকে আমাদের শীতলক্ষা নদীর দু-পাড় শিল্প কারখানার বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ভুমি খেকোর দল সেই তীর দখল করতে নানামুখী উদ্যেগ নিয়েছে। সরকার নির্বিকার। যদিও প্রতিবছর একটা সময় উচ্ছেদ অভিযান চলে। কিন্তু তা কার্যকর হয়না। আবার দখল হতে শুরু করে।
একসময় নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা এর মধ্যাঞ্চলে ক্ষেতে ধান চাষের জন্য সরকার ডি এন ডি খাল খনন করেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সেই খাল এখন সময়ের আবর্তে ১২ ফুট এর ড্রেনেজ সিস্টেমে পরিনত হয়েছে। মূলত এজন্য শিল্পকারখানার বর্জ্য দায়ী। উর্ধ্বতন মহল এ ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ। কয়েকবার এই খাল উদ্ধার কার্যক্রম অব্যহত রাখলেই ভুমিখেকো এবং শিল্পউদ্যেক্তাদের এবং সরকারের কর্তৃপক্ষ ঘুমিয়ে থাকার কারনে তা সফলতার মুখ দেখেনি।
২০০৬ সালে ঢাকার হোটেল শেরাটনে “ঢাকাকে কিভাবে বসবাসযোগ্য করা যায়” এই শিরোনামের একটি সেমিনারে অতিথি হিসেবে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। সেখানে আমি বলেছিলাম বর্তমান অবস্থায় ঢাকা শহরকে বসবাসযোগ্য  রে গড়ে তোলার সুযোগ নেই । ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে হলে আগে সমস্ত দেশকে বসবাস যোগ্য করতে হবে।
আমরা পরিবেশের কথা না ভেবে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য জন্য গোটা পরিবেশকে নিজ হাতে হত্যা করছি। আমরা ভাবছিনা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা। তাদের জন্য আমারা কেমন বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছি আমরা সেচিন্তা করছিনা। দেশে পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে। তবে তা কাজীর গরুর মত। কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। পরিবেশ রক্ষায় যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নিজেদের আন্তরিকতা থাকলে সেখানে আইনের প্রয়োজন নেই। তাই দেশের পরিবেশ রক্ষায় নতুন প্রজন্ম তথা তরুণদের ভাবতে হবে এবং পরিবেশ রক্ষায় এখন থেকেই নিজে সচেতন হতে হবে এবং অন্যকে সচেতন করতে হবে। অন্যর আশায় বসে না থেকে এ শুভ কাজটি আজ থেকে তোমাকেই শুরু করতে হবে। তোমাদের হাতেই বাংলাদেশ হবে পরিবেশ বান্ধব  আধূনিক এক দেশ। যা বিশ্বের ইতিহাসে অনুসরনীয় হয়ে থাকবে।
[লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, সাবেক সভাপতি, রিহ্যাব।]

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৭:১৭ | বুধবার, ০৫ মার্চ ২০১৪

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com