| বুধবার, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট
বর্তমান সময়ের সাথে তালমিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ।দেশের সবকিছু সময়ের সাথে পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি আমাদের মানব সমাজের মনমানসিকতা।আর আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন না হওয়ার কারণে আজ আমাদের নারীসমাজ বিভিন্ন ভাবে আমাদের দেশের প্রতিটি সমাজে বিভিন্নভাবে নিগৃহিত হচ্ছে।বিশেষ করে আমাদের সমাজে নারী সমাজ যৌতুকের কারণে সবচেয়ে বেশী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।যৌতুক একটি সামাজিক ক্যান্সার। এর বিষক্রিয়ায় আমাদের গোটা সমাজ আক্রান্ত। বর্তমানে যৌতুক প্রথার ভয়াবহতা বাড়লেও এর প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই।
নারীজীবনে এ প্রথা অভিশাপস্বরূপ। প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হচ্ছে যৌতুকের কারণে। অসংখ্য নারীর সুখের সংসার ভেঙে যাচ্ছে যৌতুকের অভিশাপে। যৌতুকের করাল গ্রাসে নারীর সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা লাঞ্ছিত হচ্ছে। যৌতুক প্রথা কেবল নারীকে মর্যাদাহীনই করে না বরং নারী জাতিকে সম্মান হানীর চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে।. বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যৌতুক দেয়া এবং যৌতুক নেয়া দুটোই অপরাধ? আর যৌতুকের কারণে কেউ আত্মহত্যা করলে প্ররোচনাকারীর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিনিয়তই যৌতুকের বলি হচ্ছেন নারীরা। সারা দেশেই যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন, হত্যা, আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছেই।
পারিবারিক সহিংসতার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে এই যৌতুক। যৌতুক প্রতিরোধে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন।সম্প্রতি ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যৌতুককে কেন্দ্র করে গত ২০১৬ সালে ১৭৩ জন নারী খুন হয়েছেন। নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬২টি। গত ৫ বছরে এ সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। হত্যার শিকার হয়েছেন ১ হাজার ১৫১ জন নারী। ১৪টি দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এসব তথ্য সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে।খিলগাঁও থানার বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা শিল্পি আক্তার ওরফে নিপা (৩০) তার স্বামীর নাম মানিক গাজী।
গত ১৩ বছর ধরে তাদের বিয়ে হয়। বর্তমানে তাদের সংসারে ৮ বছরের এক মেয়ে রয়েছে। যৌতুকের কারণে তাকে মারধর করা হতো। একপর্যায়ে তার শিশুসন্তানকেও উচ্চ করে ফেলে দিত। আর তাকে তালাক দেওয়ার হুমকি দিত। তাদের পরিবার ৩ বার মীমাংসা করেছেন। তার পরও তাকে ডিভোর্স দেওয়া হয়েছে। আর খিলগাঁও মেরাদিয়া এলাকার আনোয়ারা বেগম (৩৮)। তার স্বামীর নাম এনামুল হক। তিনি ২ সন্তানের জননী। তাকে যৌতুকের জন্য বিভিন্ন সময় মারধর করা হতো। অন্য এক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে। আর তার কাছে যৌতুকের দাবিতে তাকে মারধর করা হয়। এছাড়া সুইটি আক্তার নামের এক গৃহবধূ জানান, তিনি এক শিশুসন্তানের মা। তার স্বামী ফজলে রাব্বী।
গত ৪ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন যৌতুকের দাবিতে মারধর করে আসছে। শাশুড়ি তার গায়ে হাত তুলছেন। আর সুখী আক্তার (২৪) নামের এক গৃহবধূ শ্বশুরবাড়িতে বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের বিয়ের ১২ বছরের মাথায় যৌতুক না পেয়ে স্বামী ও তার স্বজনরা মিলে টেস্টার দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার ডান চোখটি একেবারে উপড়ে ফেলেন। আর বাঁ চোখেও ছিল মারাত্মক আঘাত। ঘটনাটি ২০১৫ সালে জিঞ্জিরা এলাকায়। আমাদের দেশে বর্তমানে দেখা যায়,সব শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে যৌতুক নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আর এই যৌতুক বিয়ের আগে থেকে শুরু হয়ে চলতে থাকে। যৌতুকের দাবি মেটাতে গিয়ে কনের পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। আবার এ দাবি মেটাতে না পারলেই নেমে আসে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা।
যৌতুকের কারণে অনেক নারীকেই হত্যার শিকার হতে হচ্ছে। আবার মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলেও অনেকে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। গত ২০১৬ সালে বিয়ের ৫ বছর পর যৌতুক দিতে রাজি নন পাবনার শম্পা খাতুন (২৫)। এ কারণে বেঁচে থাকার অধিকারই হারিয়ে ফেলেন তিনি। যৌতুক না পেয়ে স্বামী ও তার স্বজনেরা শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন শম্পাকে। নারীরা যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হলেও সংসার করার জন্য আইনের আশ্রয় নেন না অনেক নারীই। পাশাপাশি, আইনি পরিবেশ নারীবান্ধব না হওয়ায় কম যাচ্ছেন। আর অপরাধীরা সব সময়ই প্রভাবশালী থাকে, তাদের বিরুদ্ধে বিচার হয় না।
আসক এর সূত্রমতে, গত ২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে ১২৬ জন নারীর ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। আর ১০৮ জন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন, আর নির্যাতন সইতে না পেরে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন এক জন, যৌতুকের মামলা হয়েছে মোট ৯৫টি এর আগের ২০১৫ সালে যৌতুকের কারণে ১৮৭ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছিল আর আত্মহত্যা করেন ১ জন এবং ১০১ জন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন, একই কারণে ২০১৪ সালে ১৬৩ জন নারীকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়, আত্মহত্যা করেন ১১ জন, নির্যাতন সইতে না পেরে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান একজন, ১২১ জন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন, আর ২০১৪ সালে যৌতুকের মামলা হয় মোট ১৩৯টি, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে যৌতুকের দাবিতে এক গৃহবধূকে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে থানা পুলিশ প্রথমে মামলা নেয়নি। পরে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করার পর ঘটনাটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করে পুলিশ।
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কেল্লাবাড়ী গ্রামের স্বপ্না বেগমের সঙ্গে (২৩) বালিয়াকান্দি উপজেলার মদনডাঙ্গী গ্রামের তোকেনের ছেলে এরশাদের (৩০) ছয় বছর বিয়ে হয়। স্বপ্নার স্বামী এক লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। টাকা দিতে না পারায় গভীর রাতে স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন স্বপ্নাকে মারধর করেন। একপর্যায়ে তারা স্বপ্নার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। তাকে প্রথমে বালিয়াকান্দি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ও পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া, মাদারীপুরের কালকিনি পৌর এলাকার দক্ষিণ রাজদি গ্রামে তানিয়া বেগম (২৫) নামের এক গৃহবধূকে যৌতুকের দাবিতে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
এই ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ গত ১৫জানুয়ারী(বুধবার) বিকেলে রেজাউল মৃধাকে গ্রেপ্তার করে। ২০০৭ সালে কালকিনি উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বনগ্রামের আবুল কাশেম হাওলাদারের মেয়ে তানিয়া বেগমের সঙ্গে কালকিনি পৌর এলাকার দক্ষিণ রাজদি গ্রামের কালাম মৃধার ছেলে লিটন মৃধার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাদের দুটি সন্তানও হয়। বিয়ের সময় দুই লাখ টাকা যৌতুক নেয়। পরে আরো দুই লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে। এই টাকার জন্য তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ওই গৃহবধূকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। তারই জেরে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তানিয়ার শরীরে আগুন লাগিয়ে হত্যার চেষ্টা করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
এসময় তার চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা এসে তাকে রক্ষা করেন। তাছাড়া, যশোরের কেশবপুরে যৌতুকের দাবিতে এক গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে পাষন্ড স্বামী। গত ১৮জানুয়ারী(শুক্রবার) দুপুরে উপজেলার কুশুলদিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার শিকার গৃহবধূ জেসমিন খাতুন (২২) ওই গ্রামের রবি মোড়লের স্ত্রী। মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় প্রথমে তাকে কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে জানা যায়।নারী নির্যাতন রোধ করতে হলে, বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। আর সামাজিকভাবে জনসচেতনা বাড়াতে পারলেই যৌতুকের ঘটনা কমে যাবে। আর তাহলেই যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের ঘটনা বন্ধ হতে পারে বলে দেশের বিজ্ঞমহল মনে করেন। যৌতুকের কুফল সম্পর্কে গণমানুষকে সচেতন করার জন্য দেশের গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা বেশ কার্যকর ও ফলপ্রসু হতে পারে।
জনমানুষকে যৌতুকবিরোধী আইন সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সংবাদ, ফিচার, আলাদা সাময়িকী, নাটিকা, বক্তব্য, বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। আন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগও ফলপ্রসু ভূমিকা পালন করতে পারে যেমন, মহিলা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, কর্মশালা ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতন করা। এছাড়া লোকমাধ্যম যেমন যাত্রাপালা এবং শোভাযাত্রা, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে যৌতুক বিরোধীর প্রচারণার মাধ্যমে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যৌতুকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে জোরদার করার মাধ্যমে যৌতুক নির্মূলের উপায় হিসেবে ভাবা যেতে পারে।
এগুলোর পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টিকে অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সচেতনতার বিষয়টি সর্বপর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার। তবে উপায়টি শুধু যৌতুকের কুফল এবং আইন সম্পর্কেই জানানো নয়, নারীদের আত্মমর্যাদা এবং ক্ষমতায়ন সম্পর্কে সচেতন হতে বলাটা বেশি জরুরি। সর্বোপরি সচেতনতা এবং মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন যৌতুক নির্মূল করতে পারে। কিন্তু একদিনেই সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে এমন নয়। দিনের পর দিন সচেতন করার নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কাঙ্খিত সাফল্য লাভ করা যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
Email-ganipress@yahoo.com
Posted ০৭:২৭ | বুধবার, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin