বাছির জামাল
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতির সংকটের মূলসূত্র নির্দেশ করেছেন এভাবে: “In developing countries politics tends to be war without bar. On the other hand, politics tends to be a game played under some rules and regulations in developed nations. Problem of political development essentially hinges on the question of how to transfer this politics of war into a politics of game” অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনীতির প্রবণতা হচ্ছে বাধাহীনভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। অন্যদিকে উন্নত দেশে কতকগুলো বাধা নিষেধ ও নিয়মনীতির আওতায় রাজনীতি খেলা বিশেষ হিসেবে নিয়ন্ত্রিত হয়। রাজনৈতিক উন্নয়নের মূলসূত্র হচ্ছে: কীভাবে ‘যুদ্ধের রাজনীতি’কে ‘খেলার রাজনীতি’তে রূপান্তর করা যায়।
(তালুকদার মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশের রাজনীতি সংকট ও বিশ্লেষণ, শুভ প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৩, পৃষ্ঠা-১০১)
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নবীন, কিন্তু সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ‘রাজনৈতিক ব্যক্তি’ (Political actor) লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রাজনীতির পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির একজন বিদগ্ধ পর্যবেক্ষক তালুকদার মনিরুজ্জামানের উপর্যুক্ত উপতত্ত্ব তুলে ধরা হলো। অন্যসব উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মতই বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সংকট ওই ‘যুদ্ধের রাজনীতি’কে কীভাবে ‘খেলার রাজনীতি’তে রূপান্তর করা যায়। তারেক রহমানের রাজনীতির বিচার-বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি বাংলাদেশে যে ‘যুদ্ধের রাজনীতি’ চলছে, তাকে ‘খেলার রাজনীতি’তে রূপান্তরের চেষ্টায় ব্যাপৃত আছেন। এখানে বলে রাখা ভাল, তারেকের এ রাজনীতি নতুন কিছু নয়। পিতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদ জিয়ার কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে এই রাজনৈতিক দর্শন পেয়েছেন তারেক।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার চিরায়ত সৌন্দর্যই হচ্ছে রাজনীতির পক্ষ-প্রতিপক্ষেও প্রতিযোগিতা। নির্বাচকমন্ডলীকে আস্থায় নেয়ার জন্য এই প্রতিযোগিতা বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। এতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংহত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাত বদল হওয়াই গণতন্ত্রের রীতি। এটাই রাজনীতির চিরায়ত ‘রুলস অব গেম’।
(তালুকদার মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশের রাজনীতি সংকট ও বিশ্লেষণ, পৃষ্ঠা-২২)।
কিন্তু বৈরিতার ঘন অন্ধকারে যদি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন তা রাজনীতি থাকে না। তা হয়ে ওঠে নিরঙ্কুশ শত্রুতার বৃহত্তর অঙ্গন। (এমাজউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ : রাজনীতির গতিধারা, ঝিনুক প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০২, পৃষ্ঠা-১০৬)।
গত শতাব্দির বিশ শতকের দিকে স্বাধীনতা লাভকারী বিশ্বের বহু নতুন জাতির মতো ‘ভিন্ন ভাষা ও অসমগোত্রীয়’ না হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতি তাদের মতো দ্বন্দ্ব-সংঘাতে খুরে খুরে খাচ্ছে। (তালুকদার মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ রাজনীতির ভবিষ্যৎ, অন্যদিগন্ত, দৈনিক নয়াদিগন্ত-এর মাসিক প্রকাশনা, ফেব্রুয়ারি, পৃষ্ঠা-১০)
তারেক রহমান এই ‘দ্বন্দ্ব-সংঘাত’-এর ব্যবধান কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে মহাবিভক্ত দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বাধাহীন যুদ্ধকে প্রতিযোগিতাময় খেলার রাজনীতিতে রূপান্তরের চেষ্টায় ব্যাপৃত রয়েছেন। চারদলীয় জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) আমলের মাঝামাঝি সময় তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় যখন তার নবপরিণিতা বিদেশি বধূকে নিয়ে দেশে আসেন, তখন তার এই আগমনকে অভিনন্দন জানিয়ে পত্র দেন তারেক রহমান। তিনি তার দেয়া পত্রে জয়কে একটি সমন¦য়ধর্মী রাজনীতি অর্থাৎ নিজ নিজ অবস্থানে থেকে মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করে যাওয়ার আহবান জানান। (আমার দেশ, ২৩ ডিসেম্বর ২০০৪)
তিনি তার ওই চিঠিতে লিখেন, ‘প্রিয় জয়, আমার শুভেচ্ছা নিবেন। বাংলাদেশে আপনার আসার কথা শুনে খুশি হয়েছি। দেশের রাজনীতিতে আপনি যোগ দিতে যাচ্ছেন শুনেও আমি উৎসাহিত হয়েছি। আমি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমাদের আগের প্রজš§ বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। এখন সেই স্বাধীনতাকে জনগণের জন্য অর্থবহ করা, এই রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করা ও নতুন সহস্রাব্দের চাহিদা অনুযায়ী মানুষের প্রত্যাশা পূরণে আমাদেরকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কাজ করতে হবে। আমাদের প্রজন্মের কাছে এটাই দেশ ও দেশের মানুষের দাবি। স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান ও আমি আপনার এবং আপনার স্ত্রীর কল্যাণ কামনা করছি। শুভেচ্ছাসহ তারেক রহমান।’
তারেক রহমানের এই অভিনন্দন বার্তাটি বাংলাদেশের ‘অসহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতি’র কল্যাণে (!) পৌঁছতে পারেনি জয়-এর কাছে। তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী জয়-এর মা শেখ হাসিনার সহকারি প্রেস সচিব নজিব হোসেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের তখনকার সচিবালয় হাওয়া ভবনের প্রতিনিধি দলকে উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এখান থেকে চলে যান। নাটক করবেন না। এটা নাটকের জায়গা নয়।’ এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপি নেতা ৮ম সংসদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন। তিনি তখন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘আমি তাকে (নজিব) বলেছি যে, এটা একটা সৌজন্য। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এটা তো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন ধরনের স্বাভাবিক সৌজন্য আমাদের প্রজন্ম থেকে আবার শুরু হোক। এই প্রত্যাশা নিয়েই বিএনপি নেতা তারেক রহমানের অভিনন্দন বার্তা পৌঁছে দিতে এসেছি। এ কথা বলার পরও নজিব হোসেন আমাদের ঢুকতে দেননি। চিঠিও নেননি। বরং প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করেছেন।’ এর আগেও তারেক রহমান ঈদ কার্ড, নববর্ষের কার্ডসহ বিভিন্ন উৎসবে সুধা সদনে (জয়-এর পিতা এম ওয়াজেদ মিয়া সুধা’র ধানমন্ডির বাসভবন) পাঠিয়েছিলেন।
দেশে যখন এক রাজনৈতিক দলের নেতা ভিন্ন মতাদর্শী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, মুখ দেখাদেখি করতেও ভয় পান, তারেক রহমান তখন ওই অভিনন্দন বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, রাজনীতির হিমালয় পর্বতে ‘মনান্তরের’ যে বরফ জমা পড়েছে, তা গলতে শুরু করুক। হয়তবা অদূর ভবিষ্যতে মনান্তরের এই বরফ গলে গলে বহতা নদীর স্বচ্ছ পানির মতই একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের সৃষ্টি হবে- যেখানে ‘মতান্তররের’ কারণে ‘মনান্তর’ ঘটবে না, রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে না সুন্দর সামাজিক সম্পর্ক।
অভিনন্দন বার্তাটি পাঠানোর পর প্রতিপক্ষ থেকে যে ধাক্কা পেলেন, তাতেও দমে যাননি তারেক। পিছপা হননি দেশে একটি সুষ্ঠু ও সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা গড়ে তোলার উদ্যোগ থেকে। তা না হলে তারেক তার অভিনন্দন বার্তাটি ফেরত দেয়ার প্রায় এক বছরের মাথায় টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করতেন না। (আমার দেশ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৫)
২০০৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটি। সৌভাগ্যক্রমে এ প্রবন্ধের লেখকও তারেকের সফরসঙ্গী ছিলেন। গোপালগঞ্জে বিএনপি প্রতিনিধি সভা শেষে ঢাকা ফেরার পথে আকস্মিকভাবেই টুঙ্গিপাড়ায় যান তিনি। রাত ৮টা ২৪ মিনিট থেকে ৮টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত প্রায় ১১ মিনিট মাজারে অবস্থান করে দোয়া দরুদ পড়েন। জিয়ারত শেষে সাংবাদিকদের তারেক রহমান জানান, ‘শ্রদ্ধেয় নেতা হিসেবে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। দেশের জন্য তার অনেক অবদান রয়েছে। (আমার দেশ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৫)। এর আগে তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেছিলেন।সহিষ্ণু রাজনৈতিক আচরণ প্রতিষ্ঠার জন্য তারেক রহমান প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের মোকাবেলায় এলাকার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা বলেছেন। (ইত্তেফাক, ৬ মার্চ ২০০৫)
নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ভিন্ন দুটি ইউনিয়ন প্রতিনিধি সভায় বক্তব্য রাখাকালে বলেন, উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি দিয়ে বিশৃঙ্খল রাজনীতির মোকাবেলা করতে হবে। জাতীয় ঐক্য সমঝোতা ছাড়া কোনো দেশ বেশিদূর এগুতে পারে না। বিএনপি জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতায় জোর দিয়েছে। এ জন্য রাজনীতিতে ‘রুলস অব গেম’ চালু করার কথাও বলেন তিনি। (আমার দেশ, ৩০ মার্চ ২০০৫)
রাজনীতির অন্যতম রুলস অব গেম হচ্ছে সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়া। তা না-হলে এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তার বৈধতা থাকে না। সরকার বৈধতা না পেলে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা অস্থির হয়ে ওঠে। এই জন্যই কি না জানি না, বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনী ফল মেনে না নিলেও মহাজোট-এর সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেয়, সংসদে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। (প্রথম আলো ১৬ জানুয়ারি ২০০৯)
এ ছাড়াও বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। এমন নজির এর আগে দেখা যায়নি। বিএনপি এর কারণও ব্যাখ্যা দিয়েছে। দলটি বলেছে, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে যে অনির্বাচিত সরকার জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের কাঁধে বসেছিল, তাকে সরানোর জন্য ভোট কারচুপির মাধ্যমে গঠিত তথাকথিত নির্বাচিত সরকার ঢের ভাল। (আমার দেশ, ২ জানুয়ারি ২০০৯)
নির্বাচনী ফল মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আবার শেখ হাসিনার মহাজোট-এর সরকারকে দেশ পরিচালনার সুযোগ দেয়ার যে সিদ্ধান্ত বিএনপি নিয়েছিল, তার পেছনে তারেক রহমান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিলেন। সরকার গঠনের পর প্রথম এক বছর আন্দোলনের কোনো কর্মসূচিও দেয়নি দলটি। তারেক রহমান চান, দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে আসুক।
এর আগেও এমন হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের ৭ম সংসদ নির্বাচনের কারচুপির অভিযোগ করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। এই নির্বাচনের ফল মেনে না নেওয়ার কথাও বলেছিলেন। তবে দেশের মধ্যে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টির আশংকায় শেষে তার মতও পরিবর্তন করেছিলেন। (মাহমুদ শফিক, খালেদা জিয়ার উত্থান, সূচিপত্র, জানুয়ারি ২০০২ পৃষ্ঠা ৫১)
কিন্তু আওয়ামী লীগ রাজনীতির এই ‘রুলস অব গেম’ মানেনি। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের চোখে একান্নব্বইয়ের নির্বাচন অবাধ হলেও তারা অভিযোগ করেছিলেন ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র। (এম. সাইফুর রহমান, কিছু কথা কিছু স্মৃতি, হাক্কানী পাবলিশার্স, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, পৃষ্ঠা ২৭৪)। এজন্য এই দলের নেত্রী ও তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি সরকারকে একদিনও শান্তিতে না থাকতে দেয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। (মাহমুদ শফিক, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৫০)
তাই বিএনপি’র এই সরকারের শেষ আড়াই বছর ছিল রাজনৈতিক সংঘর্ষে জর্জরিত। এমনকি তখন আওয়ামী লীগ ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করে তাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশ করতে বাধ্য করেছিল। এর মাধ্যমে প্রশাসন ‘পলিটিসাইজ’ হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনও শেখ হাসিনা মেনে নেননি। বলেছিলেন, স্থূল কারচুপির কথা। (এম. সাইফুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৮৩)
তারেক রহমানের রাজনীতির আরো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি মনে করেন, যিনি রাজনীতিতে অংশ নিবেন, তার নির্দিষ্ট পেশা থাকতে হবে, বৈধ উপার্জনের পথ থাকতে হবে। (প্রথম আলো, ২১ মার্চ ২০০৫)
পাবনা-সিরাজগঞ্জ জেলার তৃণমূল সভায় এক তৃণমূল নেতা বলেছিলেন, ‘কিছুই করি না, বিএনপি করি।’ এই বক্তব্যের জবাবে তারেক রহমান বলেছিলেন, ‘কিছু করি না, বিএনপি করি’- তা বললে চলবে না। নির্দিষ্ট পেশা থাকতে হবে। বৈধ উপার্জনের পথ থাকতে হবে। অন্যদেরও কর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
রাজনৈতিক মাঠকে সুষ্ঠু করার কাজের পাশাপাশি তারেক রহমান বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) একটি ‘প্লাটফরমধর্মী দল’ থেকে ‘রাজনৈতিক দল’-এ রূপান্তরের কাজে ব্রতী হন। এ জন্য ক্যাডারভিত্তিক দল কমিউনিস্ট পার্টি ও জামায়াতে ইসলামির মতো দলীয় পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করে সংগঠনের আদর্শ নিষ্ঠ কর্মীবাহিনী তৈরির কাজেও হাত দিয়েছিলেন। (Talukder Maniruzzaman, Politics and Security Of Bangladesh, UPL ১৯৯৪, চ-২৪) অবশ্য প্রতিষ্ঠার পরই বিএনপিকে একটি রাজনৈতিক দল-এ রূপান্তরের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এ জন্য তিনি একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। (জিয়াউর রহমান, আমার রাজনীতির রূপরেখা, ২০ মার্চ ১৯৯১, পরিবেশক : স্টুডেন্ট ওয়েজ, পৃষ্ঠা-৪০)। তিনি বলতেন, প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনীই রাজনৈতিক দলের প্রাণ। (ওই, পৃষ্ঠা-২)
এরপর খালেদা জিয়া দলের দায়িত্ব নেন। স্বামী জিয়াউর রহমান শাহাদাৎ বরণ করার পর ’৮২ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন। ’৮৩ সালের মার্চে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। একই বছরের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় প্রথম ভাষণ দেন। এরপরই তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে নির্বাচিত চেয়ারম্যান হন। (বিএনপি’র সংগ্রাম ও গৌরবের ৩১ বছর, পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল উপলক্ষে বিএনপির প্রকাশনা, ডিসে¤¦র ২০০৯, পৃষ্ঠা-৪৪)।
তিনি দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এ সময় বিএনপি’র বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়। এই ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন, দেশে গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন তিনি। এ প্রসঙ্গে এম. সাইফুর রহমান বলেন, দলের মধ্যে গড়ে ওঠা নেতৃত্বের কোন্দল নিরসন, নেতাকর্মীদের সংগঠিত করা এবং সেই সাথে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়ার অনমনীয় ও দৃঢ় ভূমিকা বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অবিষ্মরণীয় হয়ে থাকবে। (এম. সাইফুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৭০)। এসব কারণে তার সময়ে দলের প্রশিক্ষণের কাজটি করা যায়নি।
তারেক রহমান প্রশিক্ষণের দিকে নজর দেন। তিনি প্রশিক্ষণের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলতেন, বিশাল সংগঠনের প্রয়োজন নেই। সলিড সাচ্চা লোক চাই। (যুগান্তর, ৯ নভেম্বর ২০০৪)। এই সাচ্চা-সলিড কর্মীবাহিনী তৈরির জন্য তিনি প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। চারদলীয় জোট সরকারের একেবারে শেষ দিকে সরকার কীভাবে চলে, তা শেখানোর জন্য ছাত্রদলের নেতাদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার ছক তৈরি করে রেখেছিলেন। সময়াভাবে তা করতে পারেননি। এ সম্পর্কে তিনি জানান, দেশের আগামী দিনের কর্ণধার হিসেবে ছাত্রদলের নেতাদের রাষ্ট্র, দেশ ও সরকার সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়ার জন্যই এই কর্মসূচির প্রয়োজন। (আমার দেশ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৫)
রাজনৈতিক নেতাদের প্রশিক্ষণ যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা তারেক রহমান বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই সারাদেশে তিনি যে তৃণমূল সভা করেছিলেন, সেসব সভার একটি ঘণ্টা থাকতো প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ। রাজনীতিতে প্রশিক্ষণ যে জরুরি তা রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ তাদের চিন্তায় তুলে ধরেছেন। যেমন রাজনৈতিক দর্শনের গুরু প্লেটো রাজনীতিকে কলা (Art) মনে করতেন। এ জন্য তিনি বলতেন, অন্যান্য কলা’র মতো রাজনীতিতেও জ্ঞান থাকা আবশ্যক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আঁকড়গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’-এর মূল আলোচ্য বিষয়ই হচ্ছে এই যে, যে কোনো কলাবিদের ন্যায় রাষ্ট্রবিদেরও তার পেশা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা উচিত। (মোহাম্মদ দরবেশ আলী খান, প্লেটো ও এরিস্টটলের রাজনৈতিক চিন্তা, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৮২)
আধুনিক যমানার রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অধ্যাপক হ্যারল্ড জে লাসকী’র পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, জনসাধারণকে যদি রাজনীতি এবং অন্যান্য গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করতে হয়, তাহলে রাজনৈতিক জটিলতা ও দেশের আইন-কানুন সম্পর্কে তাদের জ্ঞান থাকতে হবে। সে জন্য তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। (হ্যারল্ড জে. লাসকী, রাজনীতির গোঁড়ার কথা (অ্যা গ্রামার অব পলিটিক্স) এম এ ওদুদ ভূঁইয়া অনূদিত, বাংলা একাডেমি, ১৯৭৬, পৃষ্ঠা-৬৫)
আমাদের রাজনীতিবিদরা শিক্ষিত, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের মধ্যেও দেশের আইন-কানুন সম্পর্কে জানার অভাব রয়েছে। একটি রাষ্ট্র কীভাবে চলেÑ তা জিজ্ঞেস করলে রাজনৈতিক দলের সভ্যদের মধ্যে ক’জন তার উত্তর দিতে পারবেন! একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতে ইসলামী কিংবা আরো কয়েকটি দল বাদে বাংলাদেশের যে দুটি দল চক্রাকারে ক্ষমতায় আসে ও যায়Ñসেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে রাষ্ট্রসহ রাজনীতি বিষয়ে সাংগঠনিকভাবে হাতে-কলমে শেখানোর-জানানোর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। জিয়াউর রহমানের পর বিএনপিতে এই কাজটি ফের শুরু করেন তারেক রহমান। কেননা, রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যারা আসীন হবেন, তাদের ব্যাপারে তারেক যা মনে করেনÑতা প্লেটোর ভাষায় বলতে হয়, ‘রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতা অজ্ঞদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে যতক্ষণ না দার্শনিক বা জ্ঞানীর হাতে ন্যস্ত হবে, ততক্ষণ মানুষের মুক্তি নেই।’
(প্লেটোর রিপাবলিক, অনুবাদে সরদার ফজলুল করিম, ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়, ডিসেম্বর ১৯৮২, ভূমিকা, ৩৩)