এবার ক্ষমতায় এসে মহাজোট সরকার আবহমান বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি একেবারে পাল্টে দিয়েছে। কিছু মূল্যবোধ, কিছু নৈতিকতা, অনেক ধর্মাচার ও সম্ভ্রমবোধ উপড়ে ফেলা হয়েছে। এক সময় আওয়ামী লীগ শুধু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তৎপর ছিল। সেই স্বপ্ন্ এখন ফুরিয়ে গেছে। বিগত পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতাচর্চা করেছে। এখনো ফিতা কাটা ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের নামে ভোট চাওয়ার ও ইচ্ছা পূরণের রাজনীতি অব্যাহত আছে। ক্ষমতাকে উপভোগ করার ধারাও অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগের পাশে যারা দাঁড়িয়েছে তারা বাম রাজনীতির নিকুচি করে ক্ষমতার স্বাদ নেয়ার একটা বাসনা পূরণ করেছে। আওয়ামী লীগ ও তারা মিলেমিশে গণতন্ত্র, সংবিধান, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, দেশের স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণ ভাবনার একটা নিজস্ব সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দাঁড় করেছে। নিজেরা সেজেছে বিপ্লবী, বিরোধী দলকে বলছে প্রতিবিপ্লবী। তারা পাঁচ বছর সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে শুধু ক্ষমতাচর্চা করেনি, উপভোগও করেছে। এখন প্রধানমন্ত্রী বলছেন, তিনি শান্তি চান, প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়। এমন বক্তব্যে শান্তির প্রতি তার আকুতি ও প্রত্যাশা ফুটে ওঠে, যার সাথে বাস্তবতা ও অঙ্গীকারের কোনো মিল নেই। তিনি অনেক কিছু অর্জন করলেও বিশ্বাসযোগ্যতাটা খুইয়েছেন। যে সময় জাতি চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে, হরতালে দেশ অচল হয়ে পড়েছে; বোমা, ককটেল, রাবার বুলেট ও আগুনে যখন নগর-বন্দর ক্ষতবিক্ষত; সারা দেশ থেকে রাজধানী যখন বিচ্ছিন্ন, তখন সরকারের প্রধান নির্বাহীর শান্তির সপক্ষে জোরালো বক্তব্য স্বভাবতই মানুষকে আশাবাদী করে, কিন্তু ভরসা জোগায় না। তবে একের পর এক চাতুরী ও চালাকির কারণে সরকার নিজের খোঁড়া গর্তে পড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছেমতো নির্বাচন কমিশন পরিচালনা, আচরণবিধি পরিবর্তন, দুদক আইন সংশোধন কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে না। তার ওপর সমঝোতার যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা আর অবশিষ্ট নেই। শেখ হাসিনার একদিন আগের দেয়া বক্তব্য পরদিন পাল্টে যায়। তাই আশাবাদ তখনই শুধু ফিকে হয়ে যায় না, প্রধানমন্ত্রী জনমত উপেক্ষা করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকে সাংবিধানিক দায় বলে মন্তব্য করলে বিশ্বাসযোগ্যতার শেষ চিহ্নটুকুও মুছে যায়। মন্ত্রীদের পদত্যাগ নিয়েও জাতির সামনে সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। এইতো সেদিন প্রধানমন্ত্রী খতিব ও ইমামদের সামনে যখন শান্তির পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখনো বিরোধীদলীয় নেতা কার্যত অবরুদ্ধ। প্রথমসারির প্রায় সব বিরোধীদলীয় নেতা কারাগারে।
বিরোধী দলের অফিসগুলো নিñিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে আছে। মামলাবাজির যেন শুমার নেই। বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে। অসংখ্য বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর ভিড়ে কারাগারগুলোতে তিলধারণের ঠাঁই নেই। ভিন্ন মতের মিডিয়া আক্রোশের শিকার। বন্ধ রয়েছে তিনটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রেসে ঝুলছে তালা। ভিন্ন মতের বুদ্ধিজীবীদের মতের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার জন্য চলছে হুমকি-ধমকি ও বোমাবাজির মতো ঘটনা। ড. ইউনূস, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, শফিক রেহমান, আসিফ নজরুল, ফরহাদ মজহার, পিয়াস করীমরা আক্রোশের শিকার। নুরুল কবির ও আসাফউদ্দৌলা টার্গেট হয়েছেন। তুহিন মালিকও বাদ পড়েননি। মানবাধিকার কর্মীরাও শিকার হচ্ছেন গ্রেফতার ও মামলার। অধিকারের আদিলুর রহমান ও এলানকে কী হেনস্তাই না করা হচ্ছে। টিআইবিকেও খামোশ করতে চেয়েছে। বিদেশী মিডিয়ার বিরুদ্ধে মামলার বাহাদুরি দেখিয়েছে। ক্ষমতা নিরাপদ করার জন্য এতটা প্রতিহিংসাপরায়ণতা আগে দেখা যেত না। ভিন্নমত উপড়ে ফেলার এমন ধৃষ্টতা প্রদর্শনের নজিরও খুব একটা নেই। আদর্শকে আদর্শ দিয়ে, মতকে মত দিয়ে মোকাবেলার দিন যেন ফুরিয়ে গেছে। ক্ষমতার এখন ১০ হাত। অকটোপাসের মতো মানুষকে চিবিয়ে খেতে উদ্যত। একতরফা ও পাতানো নির্বাচনে যাওয়ার মরণ নেশায় মত্ত। রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলের মুষ্টিতে রেখে নিপীড়নের পথ খোলা হয়েছে। অথচ জনগণের পরিবর্তনকামী মানসিকতা রুখে দেয়া সহজ নয়। এই জনমত উপড়ে ফেলাও কঠিন। দলমত নির্বিশেষে দেশের প্রায় সব মানুষ এখনো যে নামেই হোক নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার চাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী এই সার্বজনীন মত ও জাতীয় ঐকমত্যের ধারণাকে শুধু উপেক্ষাই করছেন না, নানা ভাষায় এ দাবি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এতটাই সংবিধানভক্ত ও অনুরক্ত সেজেছেনÑ অবশিষ্ট কোনো মানুষ যেন সংবিধান পড়ে না, বোঝে না। জনমতের প্রতি এ ধরনের অশ্রদ্ধা প্রদর্শন তখনই সম্ভব, যখন একটি সরকার ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে নিজের ইজ্জত-সম্মানকেও তোয়াক্কা করে না।
একসময় এরশাদকে বিশ্ববেহায়া বলা হতো। জানি না এরশাদ এখনকার পরিস্থিতি কিভাবে উপভোগ করছেন। তবে তিনি যে এখন আত্মসম্মানবোধকেই বেশি সমীহ করছেন তা বারবার জানান দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ বলে দেশের আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের সহজ বিচরণকেও কঠিন করে তুলেছেন। দেশের সম্ভ্রান্ত সব আলেম, কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষককে সরকার এতটাই কোণঠাসা করে রেখেছে, যার নজির এই জনপদে নেই বললেই চলে। আলেমসমাজ এটাকে গজব বলছেন। জানি না এই গজব কার কারণে জাতির ওপর পড়েছে। সরকার এক দিকে আধুনিক শিক্ষার ডুগডুগি বাজাচ্ছে, অন্য দিকে ধর্মীয় বিভাজনের জন্য কওমি ও আলিয়ার মধ্যে বিভক্তিরেখা টানছে। আরো শঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, অনুগত ও দরবারিদের নিয়ে আলাদা মেরুকরণ করে গ্রহণযোগ্য ইসলামি ধারাকে নির্মূল করার ষড়যন্ত্র সরকার অব্যাহত রেখেছে। কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে একধরনের মিথ্যা প্রচারণা, ছাত্রভর্তি কমিয়ে আনা এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জোর তৎপরতা চলছে। এটা যেন কোনো বিদেশী মিশন ও গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের ফরমায়েশি কাজ। পৃথিবীর কোনো দেশের শাসক নিজ দেশের ধর্মভীরু মানুষকে এতটা উপহাস করে না। কোনো শাসকই ধর্মীয় লেবাছ ও ধর্মভীরু মানুষকে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের জন্য অভিযুক্ত করে বিদেশীদের সিম্প্যাথি আদায় করে না। এক দিকে ইসলামের ভাবমর্যাদা রক্ষার মায়াকান্না শোনা যায়, আবার ইসলামকেই নিজেদের রাজনীতির প্রতিপক্ষে দাঁড় করিয়ে ছায়ার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ চালানো হয়। এক দিকে প্রধানমন্ত্রী ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলছেন, আবার মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ বলে ইসলামের মূল চেতনায় আঘাত করছেন। এক দিকে আলেমদের নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকার বলছেন, আবার আলেমদের নিগৃহীত করার সব বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। ইসলামকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কিভাবে শান্তির ধর্ম ইসলাম অনুসরণ করা যায়, তা আলেম-ওলামারাও বুঝতে পারছেন না।
প্রধানমন্ত্রীকে যারা এ কাজে উদ্বুদ্ধ করছেন তারা বাম-ডান যাই হোক, ইসলামি আদর্শের প্রতিপক্ষ। ‘বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত’ ব্র্যান্ডিং করে তারা যা অর্জন করতে চাচ্ছে, তার প্রধান ও প্রথম টার্গেট হয়ে যাচ্ছে আদর্শ হিসেবে ইসলাম। যারা জামায়াতের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন কিন্তু ইসলামের ব্যাপারে আপসহীন তারা বর্তমান পরিস্থিতি উপভোগ করছেন না। প্রধানমন্ত্রী নফল ইবাদত করেও নিজেকে ধর্মবিদ্বেষীদের কাতারে নিয়ে গেছেন। আকাশ সংস্কৃতি আমাদের জনগণকে শুধু উচ্ছন্নে নিয়ে যাচ্ছে না, ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর ধর্মচর্চার নজির চোখও খুলে দিচ্ছে। ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মোড়কে ধর্মাচার, পূজা-পার্বণ তাদের প্রগতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করে না। দাড়ি-টুপি-ইসলাম, মুসলমান, হিজাব এদেশের মিডিয়াকে অসহিষ্ণু করে তোলে। এই হীনম্মন্যতা জাগিয়ে তুলতে বর্তমান সরকার জনগণকে বাধ্য করছে। পূজা, ঠাকুরপৈতা আধুনিক, আর ধার্মিক মুসলমান ও তাদের লেবাছ অসহ্য ও প্রগতিবিরুদ্ধÑ এই প্রচারণা এখন যুবসমাজ বমি করে উগড়ে দিচ্ছে। এত কিছুর পরও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করার পক্ষে। কিন্তু পরিস্থিতি তা হতে দেয় না। আমাদের ধারণা, দেশের শান্তি-স্থিতি ফিরিয়ে আনা ও রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাই যথেষ্ট ছিল, এখনো আছে। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের শুধু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া প্রধানমন্ত্রীই নন, সরকারপন্থী জোটের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা; তার বক্তব্যই চূড়ান্ত। তিনি যদি সত্যিই শান্তির প্রত্যাশা করেনÑ তাহলে নিজের ব্যাপারে প্রত্যাশিত শান্তির পক্ষে জনগণের মতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেই পারেন। যখন বলা হচ্ছে, জনগণ ছাগলকেও মানবেÑ শেখ হাসিনাকে নয়, তখনো মানির মান আল্লাহই রাখেনÑ বলে তুষ্টি পাওয়ার ভান তারাই শুধু করেন যারা শুধুই ঘোরের মধ্যে থাকেন। এ ঘোর যেন ক্ষমতার নেশার, তাঁবেদারির এবং নৈতিকতাবর্জিত স্খলিত মানুষের। এখন সময় এবং পরিস্থিতি দুটোই পরিপক্বতা পেয়েছে। এবার উপসংহার টানার পালা।
মন্ত্রীরা পদত্যাগ করে পরিস্থিতিকে আরো ম্যাচিউরড করে দিয়েছেন। কয়েকটি কারণে দেশ এখন মন্ত্রীশূন্য। প্রথমত, তারা পদত্যাগ করেছেন। দ্বিতীয়ত, মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, মন্ত্রীরা অসত্য কিংবা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অনৈতিক কাজ করেছেনÑ এই নৈতিক কারণেও তাদের শপথ টিকে নেই। সংবিধানের সরল ব্যাখ্যা হচ্ছেÑ পদত্যাগ করার পর পদ শূন্য হয়ে গেছে। অতি চালাকের গলায় দড়ি পড়েছে। এখন সরল ব্যাখ্যা মানতেই হবে। সময় পরিবর্তনের হাওয়া এখন মহাজোটের প্রতিকূলে। কূটনৈতিক পাড়াও সক্রিয়। ভারতীয় দূতাবাসের মর্জির পরিবর্তন না হলেও প্রকাশ্য কূটনীতিতে পরিবর্তন লক্ষণীয়। শেখ হাসিনার শেষ দাওয়াই কিংবা থেরাপি বিরোধীদলীয় নেত্রী ও তার জনশক্তিকে আরো আত্মবিশ্বাসী করেছে, হতোদ্যম করেনি। শেখ হাসিনার অসংখ্য ভুল ও একরোখা দলান্ধ রাজনীতির সুফল এখন খালেদা জিয়ার ঘরে। তিনি এখন আরো বেশি আপসহীন ও আত্মপ্রত্যয়ী। তিনি ভাঙবেন পিছু হটবেন না।
সামনে চলার পথ রুখে দাঁড়ালেও তিনি লক্ষ্যচ্যুত হবেন না। পুলিশ ও আমলা প্রশাসন আত্মরক্ষার অবস্থানে বসে রক্ষণ ভাগে খেলার জন্য প্রস্তুত। এরশাদ বর্ডার লাইনে দাঁড়িয়ে ভালোই খেলছেন। নির্বাচন কমিশন বিরোধী দলের উত্তাপ অনুভব করতে বাধ্য। ইসির সাথে ভারতীয় দূতের সাক্ষাৎ সাংবিধানিক ও স্পর্শকাতর এই প্রতিষ্ঠানটিকে আরো একটু কোণঠাসা করে দিলো। তা ছাড়া বিরোধীদলীয় অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক ভাবে বিভিন্ন মতের স্টারগুলোও এখন উচ্চকণ্ঠ। একটি চূড়ান্ত মেরুকরণের প্রাক্কালে এক দিকে হরতালের পটকা, অন্য দিকে হাতির ঝিলে বিরক্তিকর আতসবাজির উৎসব। এক দিকে জনগণ ত্যক্ত-বিরক্ত। সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। শেখ হাসিনা এ সময় সঠিক মন্ত্র পাঠ করে মন্ত্রিত্ব না ছাড়লে পরিস্থিতি ও রাজনীতি দুটোরই নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। শেষ রক্ষার দায় এখন তার। এখন সংলাপে বসে দেয়া- নেয়ার শেষ সুযোগ কাজে লাগাবেন কি না তিনি জানেন। আর্তি-আকুতি, আবেদন-নিবেদন, দাবি ও অনুরোধ সব উপেক্ষা করলে তিনি দাঁড়াবেন কোথায়?
(নয়া দিগন্ত, ১৪/১১/২০১৩)