নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
ইসলামে প্রতারণা, ফাঁকি ও ধোঁকাবাজির স্থান নেই। দায়িত্বে বা কাজে ফাঁকি দেওয়ার মাধ্যমে মূলত তিনটি কবিরা গুনাহ সংঘটিত হয়। ১) আমানতের খেয়ানত। ২) চুরি ও ৩) জুলুম।
কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে দায়িত্বে অবহেলা করা আমানতের খেয়ানত। মালিকের অজান্তে বা গোপনে কাজে ফাঁকি দিয়ে পুরো বেতন নিয়ে নেওয়া চুরি করার শামিল। আর দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে বেতন—এই চুক্তি ভঙ্গ করা অতঃপর অধিকারের নামে মালিকের কাছ থেকে বেতন বুঝে নেওয়া জুলুমের নামান্তর।
আলেমদের মতে, এই তিনটি বড় পাপের কারণে ওই উপার্জন সন্দেহাতীতভাবে হারাম হয়ে যায়। আর হারাম উপার্জনের কারণে ওই অপরাধীকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন তো হতে হবেই, তার কোনো ইবাদতও কবুল করা হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন- ‘হে মানবজাতি, তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু আহার করো, আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু..’ (সুরা বাকারা: ১৬৮-১৬৯)
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানুষ, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র। তাই তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তাআলা রাসুলদের যা আদেশ করেছেন; মুমিনদেরও তাই আদেশ করেছেন। এরপর তিনি তেলাওয়াত করেন, ‘হে রাসুলরা, তোমরা পবিত্র খাদ্য আহার করো এবং ভালো কাজ করে যাও। তোমরা যেসব কাজ করো তা সম্পর্কে আমি পরিপূর্ণ অবগত।’ (সুরা মুমিনুন: ৫১)
তিনি আরো তেলাওয়াত করেন, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে তোমরা পবিত্র ও উত্কৃষ্ট বস্তুগুলো আহার করো।’ এরপর তিনি এক ব্যক্তির কথা বর্ণনা করে বললেন, দীর্ঘ ভ্রমণের এলোমেলো চুল ধুলামলিন চেহারার ব্যক্তির দুই হাত আকাশের দিকে তুলে বলছে, হে আমার রব, হে আমার রব, অথচ তার আহার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম। তার হারাম খাবার দিয়ে পুরো দেহ গড়ে উঠেছে। তাহলে তার এত দোয়া কীভাবে কবুল হবে?’ (মুসলিম: ১০১৫)
দায়িত্বশীলতা বড় আমানত
ইসলাম আমানত রক্ষায় জোর তাগিদ দিয়েছে। আর যথাযথ দায়িত্ব পালন পবিত্র আমানত। আল্লাহ তাআলা আমানত রক্ষা প্রসঙ্গে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলো প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও। আর যখন মানুষের বিচার-মীমাংসা করবে, তখন ন্যায়ভিত্তিক মীমাংসা করো। আল্লাহ তোমাদের সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী।’ (সুরা নিসা: ৫৮)
আমানত পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় না করা বা খেয়ানত করা মারাত্মক গুনাহের কাজ। রাসুল (স.) একে মুনাফিক বা বিশ্বাসঘাতকের আলামত বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, ‘মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি; তা হলো- মিথ্যা কথা বলা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা ও আমানতের খেয়ানত করা।’ (বুখারি: ৩৩)
আনাস (রা.) বলেন, ‘এমন খুব কম হয়েছে, মহানবী (স.) ভাষণ দিয়েছেন— অথচ তাতে এ কথা বলেননি যে যার মধ্যে আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই। আর যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিয়মানুবর্তিতা নেই, তার ধর্ম নেই।’ (মুসনাদে আহমদ: ১২৪০৬)
দায়িত্বে অবহেলা করলে পরকালে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। হাদিসে নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যককে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে’ (বুখারি: ৮৪৪; তিরমিজি: ১২৪)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন যে তোমরা যেন মালিকের কাছে তার আমানত প্রত্যর্পণ করো।’ (সুরা নিসা: ৫৮)
সুতরাং কাজে ফাঁকি দেওয়া শরিয়ত সমর্থন করে না। তাই এক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি।
কাজ না করে বেতন নেওয়া চুরি ও জুলুম
মালিকের অজান্তে বা গোপনে কাজ না করে পুরো বেতন নেওয়া চুরি করার শামিল। যেকোনো ধরণের চুরির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন নবীজি (স.)। বলা হয়েছে, চুরি করার সময় চোরের কাছ থেকে ঈমান চলে যায়। হাদিসে এ সম্পর্কে রয়েছে, ‘জিনাকারী যখন জিনায় লিপ্ত হয়, তখন সে মুমিন থাকে না। যখন কেউ মদপান করে, তখন সে মুমিন থাকে না। কেউ চুরি করার সময় মুমিন থাকে না এবং কোনো ছিনতাইকারী এমনভাবে ছিনতাই করে যে, মানুষ তার দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকে; তখন সে (ছিনতাইকারী) মুমিন থাকে না। (সহিহ বুখারি: ৬৭৭২)
বিদায় হজের ভাষণে নবীজি (স.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানে হস্তক্ষেপ করা নিষিদ্ধ’ (মুসনাদে আহমদ: ১৬০১৯)। তাই চুরি করে হোক আর যেভাবেই হোক অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা, ভোগ করা, ঠকানো নাজায়েজ।
দায়িত্বে ফাঁকি দিয়ে অর্থ উপার্জন মানে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করা, অন্যের পাওনা হরণ করা। এটা একধরনের জুলুম বা দুর্নীতি। যা ইসলামি শরিয়তে কঠিন গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। মানবতার বিচারে জুলুম এতই অপছন্দনীয় যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা নিজের জন্যও এটি হারাম করেছেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ (মুসলিম: ৬৭৩৭)
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না, আর জেনে-বুঝে অন্যায়ভাবে মানুষের সামান্য পরিমাণ সম্পদ গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের কাছে পেশ করো না। (সুরা বাকারা: ১৮৮)
মূলত কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার মানে হলো সে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনে মেধা, চিন্তা ও শ্রম ব্যয় করা। মাসিক বেতনের বিনিময়ে তাদের প্রতিশ্রুত দায়িত্ব আদায় করা। পবিত্র কোরআনে এ ধরণের দায়িত্বশীলদের প্রশংসায় বলা হয়েছে, ‘সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম কর্মী, যে শক্তিমান ও দায়িত্বশীল। (সুরা কাসাস: ২৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দায়িত্বশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন। হালাল উপার্জন করার তাওফিক দান করুন। দায়িত্ব অবহেলা, চুরি, জুলুম ও আমানতের খেয়ানত করা থেকে হেফাজত করুন। আমিন। সূএ:ঢাকা মেলডটকম
Posted ০৫:১২ | সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Athar Hossain