| বুধবার, ০৭ অক্টোবর ২০২০ | প্রিন্ট
ধর্ষণ কান্ডে গত ক’দিন ধরে দেশ উত্তাল। পাঠকদের নতুন করে মনে করিয়ে দেবার দরকার নাই যে কোথায় কোথায় সেগুলো ঘটেছে, কারা কারা ঘটিয়েছে। আবার এই লেখা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত আর যে কোন ঘটনা ঘটে নাই বা ঘটছে না এমন ভাবারও কোন কারণ নেই। পৃথিবীতে সম্ভবতঃ ধর্ষণ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়, লেখালেখি হয়, কথা হয় এবং হচ্ছে যেমনটি আমিও লিখছি! কিন্তু ধর্ষণ বন্ধ হয়েছে এমন দেশ নেই বললেই চলে। অন্ততঃ পরিসংখ্যান তাই বলে। নেটে গেলে ধর্ষণের নানা সংজ্ঞা পাওয়া যায়। টিভি খুললে ধর্ষণের সংবাদ, পত্রিকায় ধর্ষণের খবর, আছে ফেইসবুকে, আছে ইউটিউবেও। আপনি না চাইলেও আপনাকে দেখতে, পড়তে বাধ্য করবে এসব মাধ্যম। কোনটা গা ঘিনঘিনে, কোনটা রসিয়ে রসিয়ে, কোনটা আবার সুড়সুড়ি দিয়ে পরিবেশন করা হয়। কাটতি বাড়ানোর ন্যাংটো প্রয়াস।
শুধু দেশেরই নয়, প্রতিবেশি দেশের কয়েকটি ঘটনাও আলোচিত বেশ ক’দিন ধরে। টিভি টক-শো কিংবা বক্তৃতা/মন্তব্যে বিদগ্ধজনেরা কথার খই ফোঁটান। এই করতে হবে, সেই করতে হবে! কাজের কাজ কিছুই হয় না। ধর্ষণ বন্ধ হয় না। আসলে ধর্ষণ আছে, ধরা নাই; আইন আছে, প্রয়োগ নাই! দু’একজন যদিও বা ধরা পড়ে কিংবা আইনের আওতায় আসে, সেগুলো ধর্ষকমনে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করে না। তাতে তাদের ধর্ষণদন্ড নিবৃত হয় না।
ধর্ষণ ছাড়া একটা নির্মল দিন ভাবা যায় না। ধর্ষিত হয় নারী, ধর্ষিত হয় মেয়ে, ধর্ষিত হয় শিশু (কন্যা শিশু-ছেলে শিশু উভয়ই)। আর কোথায় কোথায় হয়? তারচেয়ে বরং কোথায় হয় না সেটা খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা করা যেতে পারে। ধর্ষণ আর নারীর প্রতি নির্যাতন মানব ইতিহাসে সাম্প্রতিক নয়, ইতিহাসজুড়ে বিদ্যমান। ঘটনা আছে ধর্মে ধর্মে, আছে বর্ণে বর্ণে, আছে পূরাণে (Mythology)। গ্রীক পূরাণে এটা খুব সাধারণ ঘটনা।
রোমান আইন অনুযায়ী Raptus or Raptio হচ্ছে অপহরণ পরবর্তি যৌন নির্যাতন। অবশ্য এটা এক সময় সেখানকার সংস্কৃতির অংশও ছিলো যে কোন অবিবাহিত মেয়েকে জোর করে অপহরণ করা হতো। তারপর তাকে তার বাবা/অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ করা কিংবা যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়া। মেয়ের অনুমতি নেয়ার প্রচলণ ছিলো না। অবশ্য বিয়ের পর এখনো যে অনুমতি নিয়ে সেক্স করা হয় ব্যাপারটা তেমন নয়। আমাদের উপমহাদেশেও অসুর বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিলো। এক্ষেত্রে বলে নেয়া ভালো যে পরবর্তিতে রোমান সাম্রাজ্যে এধরণের অপহরণ এবং সেক্স করাকে ‘ক্রাইম’ হিসেবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হতো।
এখন অবশ্য পৃথিবীর প্রতিটা দেশে, প্রত্যেক ধর্মে, সমাজে ধর্ষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেই শাস্তির মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন। এমনকি Capital Punishment (মৃত্যুদন্ড) পর্যন্ত আছে। কিন্তু তারপরও ধর্ষণ বন্ধ হয় না। রিপোর্টেড কেইস নিয়ে যে পরিসংখ্যান আছে তার বাইরেও অজস্র ঘটনা ঘটে যা ব্যক্তি/পরিবারের সম্মান, লোকলজ্জা, অক্ষমতা কিংবা প্রাণনাশের হুমকি ইত্যাদি কারণে প্রকাশিত হয় না। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনা নিয়ে যে পরিসংখ্যান তৈরী তাতে দেখা যায় যে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবমতে বাংলাদেশে গত জানুয়ারী থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৮৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কোন বয়সের ক’জন এসব চুলচেরা বিশ্লেষণও আছে। আছে শতকরা হিসাবও।
তবে বিশ্বের সবগুলো দেশের ধর্ষণ পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ নীচে রয়েছে। যদিও তাতে আত্মপ্রসাদ লাভ করার কোন সুযোগ নাই। পপুলেশন রিভিউতে প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ সংঘটিত হয় দক্ষিন আফ্রিকায়। প্রতি এক লক্ষে সেখানে ১৩২.৪জন ধর্ষণের শিকার হয়। আর বাংলাদেশে প্রতি এক লক্ষে ৯.৮২জন। ভারতে এই সংখ্যা প্রতি এক লক্ষে মাত্র ১.৮০জন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ওপরে। বাংলাদেশে ধর্ষকদের কতজন শাস্তি পায় আর কতজন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় সে পরিসংখ্যান আপনি সহজেই পাবেন। তবে আমেরিকাতে প্রতি এক লক্ষে ২৭.৩জন ধর্ষিত হয়। এই ধর্ষকদের মাত্র ৯% আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়। এদের মধ্যে মাত্র ৩% শাস্তি পায় বাকি ৯৭% বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়।
কেনো আইনের আওতায় ধর্ষকদের সবাইকে আনা সম্ভব হচ্ছে না, কেনো তাদের সবাইকে শাস্তি দেয়া যাচ্ছে না – এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে, বিতর্ক হচ্ছে, হচ্ছে গবেষণাও। তবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ২ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮৪ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত। রিপোর্টেড কেইসগুলোর ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য, পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন সংখ্যাই বেশি। এছাড়া এলাকার ক্ষমতাশালী নেতা, জনপ্রতিনিধি কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হওয়ার সংখ্যাও অনেক। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এলাকায় আক্রমণকালীন সময়ে ব্যাপক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
ধর্ষণ যেভাবেই ঘটুক তা নারী, শিশু দেহে এবং মনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি স্বাভাবিক হতে পারে না। সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে না। কিছুটা হলেও সে হয়তো স্বাভাবিক হতে পারতো যদি সমাজ, রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্ষকদের যথাযথ বিচার হতো! আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এখনো ধর্ষকদের বাঁচানোর চেষ্টা চলে, ধর্ষিতাকেই দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা চলে। সাম্প্রতিক কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের আপন চাচা কর্তৃক ভাতিজি ধর্ষণের ঘটনাই তার প্রমাণ।
সুতরাং, লেখালেখি, টক-শো, সভা-সেমিনার আর গবেষণা করে ধর্ষণের মত সামাজিক ব্যাধি দূর করা সম্ভব হবে না। প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। কিন্তু পারিবারিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। ধর্ষককে প্রথমে পরিবার থেকেই বর্জন করতে হবে। ধর্ষকের ঠাঁই হবে না সমাজে, রাজনীতিতে, রাষ্ট্রে – এটা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবার থেকে ধর্ষণ আর ধর্ষকের প্রতি ঘৃনার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। টিভি সিরিয়াল, সিনেমাসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌন সুড়সুড়িমূলক অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কারিকুলামে যৌন সচেতনতামূলক বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। তবেই গড়ে উঠতে পারে ধর্ষণবিরোধী মূল্যবোধ।
পপুলেশন রিভিউর তথ্য মতে, আমাদের দেশে প্রতি এক লক্ষে ধর্ষণের শিকার ৯.৮২জন অর্থাৎ ধরে নিলাম ধর্ষকও ততজন। তাহলে এক লক্ষ্যে মাত্র দশ জন ধর্ষককে আমরা নিবৃত করতে কিংবা আইনের আওতায় আনতে পারবো না – এটা হতে পারে না! তার জন্য দরকার চেতনা, ধর্ষণবিরোধী গণচেতনা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই ধর্ষণ মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে উভয়েরই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। একজন পুরুষ নামের পশু ধর্ষণ করেছে বলে সকল পুরুষ খারাপ এই মানসিকতাও যেমন অন্তরায় তেমনি পুরুষ বলেই আমি শ্রেষ্ঠ এই মানসিকতাও পরিত্যাজ্য। দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।
সমাজে সবাই খারাপ কাজ করে না, সবাই নির্যাতক-নিপিড়ক হয় না, সবাই দূর্ণীতিবাজ-চাপাবাজ হয় না, সব পুরুষ ধর্ষক হয় না, সব পুরুষ মেয়েদের দেখলেই ছোঁক ছোঁক করে না… বিয়ে করে সব পুরুষ বউকে ধর্ষণ করে না, সব পুরুষ অন্ধকারে বাস করে না।
“আমি আমার স্ত্রীর বিশ্বাসের অভয়ারন্য, সেই অভয়ারন্যে কোন হিংস্র শ্বাপদ প্রবেশ করুক আমি তা চাই না। আমি আমার কন্যার ফেয়ারী রাজ্য, স্বপ্নময় সে রাজ্য শুধুই কন্যাদের, সেখানে কোন পুরুষ নেই আছে শুধু বাবা। আমি আমার বোনদের বিশাল আকাশ, যেখানে কোন কালো মেঘ নেই। আর আমি তো আমার মায়েরই অংশ”…ভাবনাটা এমন হওয়াই উচিৎ! এই ভাবনাই আপনাকে-আমাকে-সবাইকে অন্য নারী, মেয়ে, শিশু-সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, স্নেহ আর সমাদর করা শেখাতে পারে।
(সমাপ্ত)
লেখকঃ সাংবাদিক
Posted ০৯:২৭ | বুধবার, ০৭ অক্টোবর ২০২০
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Rafiq Masum